পিতা ,পুত্র,পাকরুহ

ads20

    কিতাবুল মোকাদ্দাস শিক্ষা দেয় যে, যদিও আল্লাহ পিতা , পুত্র, পাকরুহ --- এই তিনি ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত, তবুও সাধারণ অর্থে তিন ব্যক্তি নন, বরং বেহিস্তি সত্ত্বার তিন প্রকাশ। একই সময়ে এই তিন প্রকাশ এমন প্রকৃতির হন যে, তাঁরা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন। পিতা পুত্রের সাথে কথা বলতে পারেন এবং পুত্র পিতার সাথে কথা বলতে পারেন এবং উভয় সত্ত্বা পাক-রুহকে পাঠাতে পারেন। প্রকৃত রহস্য এই বিষয়ের মধ্যে নিহিত যে, ত্রিত্ত্বের প্রত্যেক ব্যক্তি সত্ত্বা সম্পূর্ণভাবে বেহিস্তি সত্ত্বার অধিকারী (অর্থাৎ পিতা সম্পূর্ণ আল্লাহ, পুত্র সম্পূর্ণ আল্লাহ, পাক-রুহ সম্পূর্ণ আল্লাহ); এবং এই তিন ব্যক্তি সত্ত্বার একটি থেকে আরেকটির আলাদা অস্তিত্ব নাই (অর্থাৎ তিন ব্যক্তি সত্ত্বার মিলে এক আল্লাহর অস্তিত্ব)। এই তিন ব্যক্তি সত্ত্বা একজন আরেকজনের অধিনস্ত নন, যদিও এরূপ বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর অস্তিত্ব প্রকাশের ক্রমানুসারে পিতা প্রথম, পুত্র দ্বিতীয়, এবং পাক-রুহ তৃতীয়, এই ক্রম কেবলমাত্র তাদের কাজকে প্রতিফলিত করে (অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্ব প্রকাশের সময় পিতার কাজ প্রথমে প্রকাশিত হয়েছে, পরে পুত্রের কাজ প্রকাশিত হয়েছে এবং তারপরে পাক-রুহের কাজ প্রকাশিত হয়েছে)।


    ১. ত্রিত্ত্বের বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দাস ভিত্তিক প্রমাণাদিঃ

    কিতাবুল মোকাদ্দাসের পুরাতন নিয়মে বা আল-তৌরাৎ, আল-যবুর এবং নবীদের কিতাবে এমন কিছু কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর মধ্যে একাধিক ব্যক্তি সত্ত্বার অস্তিত্ব রয়েছে। এই কিতাবগুলোর বিভিন্ন বর্ণনায় আল্লাহ নিজের সমন্ধে কথা বলেছেন বহু বচনে ‘‘আমরা” শব্দ ব্যবহার করে, যেমন ‘‘ আইস, আমরা আমাদের মত করে মনুষ্য সৃষ্টি করি” ( পয়দায়েশ ১ঃ২৬); আরো দেখুন ১১ঃ৭। মাবুদ আল্লাহর দূতকে বেহিস্তি ব্যক্তি সত্ত্বায়  উপস্থাপন করা হয়েছে, পয়দায়েশ ১৬ঃ৭-১৩; ১৮ঃ১-২১; ১৯ঃ১-২২; এবং পাক-রূহ কথা বলেছেন আলাদা ব্যক্তি সত্ত্বা হিসাবে, ইশাইয়া ৪৮ঃ১৬; ৬৩ঃ১০। তাছাড়া, এই কিতাবগুলোতে এমন কিছু অনুচ্ছেদ আছে যেখানে মসীহ কথা বলছেন এবং অন্য দুইজন ব্যক্তি সত্ত্বার উল্লেখ করেছেন, ইশাইয়া ৪৮ঃ১৬; ৬১ঃ৬; ৬৩ঃ৯, ১০। আল্লাহর প’কাশের ধারাবাহিকতায়, ইঞ্জিল শরীফে আল্লাহর ত্রিত্ব বিষয়ে প্রমাণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী প্রমাণটি দেখা যায়, নাজাত প্রদান কাজের বাস্তবতায়। মানুষকে নাজাত প্রদানের জন্য পিতা দুনিয়াতে পুত্রকে পাঠালেন, এবং পুত্র পাক-রুহকে পাঠালেন। তাছাড়া বেশ কয়েকটি অনুচ্ছে রয়েছে যেখানে সুস্পষ্টভাবে তিন ব্যক্তি সত্ত্বার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ঈসা মসীহের মহান আদেশ ‘‘ ঈসা কাছে এসে তাদের এই কথা বললেন, ‘বেহেস্তের ও দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে, অতএব তোমরা গিয়া সমস্ত জাতির লোকদেরকে আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক-রুহের নামে তাদের তরিকাবন্দি দাও” মথি ২৮ঃ১৮-১৯। এবং ঈসার তরিকাবন্দির সময়েও তিন ব্যক্তি সত্ত্বাকে দেখা যায় ‘‘ তরিকাবন্দির পরে ঈসা যখন মোনাজাত করেছিলেন, তখন আসমান খুলে গেল, সেইসময় পাক-রুহ কবুতরের আকারে তাঁর উপর নেমে আসলেন এবং আসমান থেকে এই কথা শুনা গেল ‘ ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, ইহার উপর আমি সন্তুষ্ট” (লূক ৩ঃ২১); লূক ১ঃ৩৫;। প্রেরিতগণের আশির্বাদের তিন ব্যক্তি সত্ত্বার  বিষয় বলা হয়েছে, যেমন  ঈসা মসীহের রহমত, আল্লাহর মহব্বত এবং পাক-রুহের যোগাযোগ সমন্ধ তোমাদের অন্তরে সবসময় থাকুক” ( ২ করিন্থিয় ১৩ঃ১৩); আরো দেখুন ১ করিন্থিয় ১২ঃ৪-৬। সাহাবী পিতরের হেদায়েতনামায় “ পিতা আল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে তোমাদের বেছে নিয়েছেন, আর পাক-রূহ তোমাদের পবিত্র করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, যাতে তোমরা ঈসা মসীহের বাধ্য হও আর তাঁর রক্ত ছিটানোর দ্বারা তোমাদের পাক-সাফ করা হয়” (১ পিতর ১ঃ২)। 

    ত্রিত্ত্ব মতবাদের বিরোধিতাঃ

    সংস্কার আন্দোলনের যুগে সসীনীয় মতবাদীরা এবং বর্তমান যুগের আধুনিকতাবাদী ইউনিটারিয়ান মতবাদের অনুসারীরা ত্রিত্ত্ব  মতবাদকে অস্বিকার করে। ১৫৫০ খৃষ্টাব্দে ভিয়েনা কাউন্সিলে ধর্মযাজক লিলিও সুজিনী এবং ফৌসটু সুজিনী ত্রিত্ত্ব মতবাদের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করেন এবং ঘোষণা করেন যে, ত্রিত্ত্ব মতবাদ কিতাবুল মোকাদ্দাস বিরোধি। তারা ঈসার আল্লাহ হওয়া, এবং তাঁর পূর্ব অস্থিত্বকে অস্বিকার করেন। তারা ত্রিত্ত্ব শব্দ ব্যবহার করলেও একমাত্র পিতাকে আল্লাহ হিসাবে এবং পুত্রকে মানুষ এবং পাক-রূহকে আল্লাহর প্রভাব হিসাবে উপস্থাপন করেন। তাদের ব্যখ্যায় পুত্র এবং পাক-রূহ সর্বশক্তিমান আল্লাহ নন।

    ২. পিতাঃ

    কিতাবুল মোকাদ্দাসে ‘‘পিতা” নামটি ত্রিত্ত্ব আল্লাহর ক্ষেত্রে সমস্ত সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। ১ করিন্থিয় ৮ঃ৬; ইব্রানী ১২ঃ৯; ইয়াকুব ১ঃ৭। ইস্রায়েলের পিতা, দ্বিতীয় বিবরণ ৩২ঃ৬; ইশাইয়া ৬৩ঃ১৬; এবং ঈমানদারদের পিতা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে মথি ৫ঃ৪৫;৬ঃ৬,৯, ১৪। রোমীয় ৮ঃ১৫। তথাপি গভীর অর্থে ত্রিত্ত্বর প্রথম ব্যক্তিরূপে দ্বিতীয় ব্যক্তির সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, ইউহোন্না ১ঃ১৪, ১৮। ৮ঃ৫৪; ১৪ঃ১২, ১৩। এইটিই মূলতঃ পিতৃত্ব যার ক্ষীণ প্রতিফলন হল এই দুনিয়ার পিতৃত্ব। পিতার ব্যতিক্রমি বৈশিষ্ট হল যে সমস্ত অনন্তকালীনতা থেকে তিনি পুত্রকে উদ্ভব করেন। যে সমস্ত কাজ বিশেষভাবে তাঁর রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উদ্ধার কাজের পরিকল্পনা, সৃষ্টি ও বিধান এবং উদ্ধার কাজে পিতা ও ত্রিত্বের প্রতিনিধি রূপে কাজ করেছেন।

    ৩. পুত্রঃ

    ত্রিত্ত্বের দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলা হয় “পুত্র” । বা “আল্লাহর পুত্র”। তিনি এই “পুত্র” নাম ধারণ করেছেন কেবলমাত্র পিতার একজাত পুত্র হিসাবেই নয় ( ইউহোন্না ১ঃ১৪, ১৮, ৩ঃ১৬, ১৮; গালাতিয় ৪ঃ৪) বরং আল্লাহর মনোনীত মসীহ হিসাবেও (মথি ৮ঃ২৯; ২৬ঃ৬৩; ১১ঃ২৭)। এবং পাক-রূহের মধ্যদিয়ে তাঁর বিশেষ জন্ম হওয়ার গুণেও তিনি আল্লাহর পুত্র (লূক ১ঃ৩২, ৩৫)। ত্রিত্তে¡র দ্বিতীয় ব্যক্তির বিশেষ বৈশিষ্ট হল তিনি পিতার অনন্তকালীন একজাত পুত্র ( যবুর ২ঃ৭; আমল ১৩ঃ৩৩; ইব্রানী ১ঃ৫) । পিতার অনন্তকালীন সন্তান হওয়া দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে তাহল আল্লাহর বেহিস্তি সত্ত্বার  মধ্যে পুত্রের ব্যক্তিগত সত্ত্বার অস্তিত্বমান থাকা। তাঁর মধ্যস্ততাকরণ কাজের মাধ্যমে ইহা আরো সুস্পষ্টভাবে পুত্রত্ব হিসাবে আরোপ করা হয়েছে। তিনি সৃষ্টিকাজে মধ্যস্ততা করেছেন (ইউহোন্না ১ঃ৩, ১০; ইব্রানী ১ঃ২,৩) এবং নাজাতের কাজে মধ্যস্ততা করেছেন (ইফিষিয় ১ঃ৩-১৪)।

    ৪. পাক-রূহঃ

    যদিও সসেনিয় মতবাদীরা, ইউনিটারিয়ান মতবাদীরা এবং আধুনিকতাবাদীরা পাক-রূহ বলতে কেবলমাত্র আল্লাহর ক্ষমতার প্রভাবকে বুঝিয়েছেন, তবুও পাক-রূহকে কিতাবুল মোকাদ্দাসকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ইউহোন্না ১৪ঃ১৬, ১৭,২৬; ১৬ঃ১-১৫; রোমীয় ৮ঃ২৬। পাক রূহ সমন্ধে বলা হয়েছে, তিনি বুদ্ধিসম্পন্ন সত্ত্বা ( ইউহোন্না ১৪ঃ২৬); তাঁর অনুভূমি আছে ( ইশাইয়া ৬৮ঃ১০; ইফিষীয় ৪ঃ৩০); এবং তাঁর ইচ্ছা আছে ( আমল ১৬ঃ৭; ১ করিন্থিয় ১২ঃ১১)। পাক-কালামে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে তিনি কথা বলেন, অনুসন্ধান করেন, পরীক্ষা করেন, আদেশ দেন, কোনো বিষয়  প্রকাশ করেন, কোনো কিছুর জন্য চেষ্টা করেন এবং সুপারিশ করেন। তাছাড়া লূক ১ঃ৩৫; আমল ১০ঃ৩৮; ১ করিন্থিয় ২ঃ৪ আয়াতে তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা থেকে তাঁকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা দেখানো হয়েছে। তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট হল বিশেষ কাজ ও উদ্দেশ্যে তিনি পিতা ও পুত্র থেকে উৎসারিত হয়েছেন, ইউহোন্না ১৫ঃ২৬; ১৬ঃ৭; রোমীয় ৮ঃ৯; গালাতিয় ৪ঃ৬। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, তিনি সৃষ্টিকাজ এবং নাজাতের কাজ উভয় কাজ সম্পাদনের জন্য ভূমিকা রেখেছেন, (পয়দায়েশ ১ঃ৩; আইয়ুব ২৬ঃ১৩; লূক ১ঃ৩৫; ইউহোন্না ৩ঃ৩৪; ১করিন্থিয় ১২ঃ৪-১১; ইফিষীয় ২ঃ২২)


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS