ঈশ্বর আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, প্রতিটি সৃষ্টির শেষে একটি বাক্য বলা হয়েছে আর তা হল, আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সেই সকল উত্তম। কিন্তু সব শেষে যখন ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্য নির্মাণ করলেন এবং তাঁর সামনে পৃথিবীর সমূদয় সৃষ্টিকে এনে রাখলেন, যেন মনুষ্য ঈশ্বরের সৃষ্টির উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। পরে ঈশ্বর তাঁহার সৃষ্ট বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন; আর দেখ, “ সকলই অতি উত্তম।” আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ঈশ্বরই একমাত্র নিখুঁত কারিগর। কারণ মানুষের ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করে নিজ প্রতিমূর্তিতেই আমাদের নির্মাণ করেছেন। আর এই কারণ শাস্ত্র বলে, ‘ কারণ তিনিই আমাদের গঠন জানেন, আমরা যে ধুলিমাত্র, ইহা তাঁহার স্মরণে আছে’- গীত ১০৩;১৪ পদ।
তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন ঈশ্বর নিজ প্রতিমূর্তিতে মনুষ্য নির্মাণ করলেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে পবিত্র বাইবেল থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারি। যথাঃ
১। যেন মানুষ ঈশ্বরকে জানতে পারে: ঈশ্বরকে দেখা যায় না, তাই ঈশ্বরকে দেখতে হলে আন্তরিকতার সহিত পবিত্র বাইবেল অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরকে জানতে পারি। তিনি চান যেন আমরা তাঁকে জানি আর এই কারণ তিনি আমাদের কাছে তাঁর বাক্য (পবিত্র বাইবেল) দিয়েছেন।
# ঈশ্বর আত্মা, আমাদের মত তাঁর কোন শারীরিক দেহ নাই। আর এই কারণ শাস্ত্র আমাদের কাছে প্রমাণ করে যে, “ঈশ্বর আত্মা, আর যাহারা তাঁহার ভজনা করে, তাহাদিগকে সত্যে ও আত্মায় ভজনা করিতে হইবে”- যোহন ৪;২৪ পদ।
# ঈশ্বর তিনি একজনই: যিশাইয় ৪৫;৫ পদে বলা হয়েছে, “আমিই সদাপ্রভু, আর কেহ নয়, আমি ব্যতিত অন্য ঈশ্বর নাই; তুমি আমাকে না জানিলেও আমি তোমার কটি বদ্ধ করিব।
# ত্রিত্ব ঈশ্বর: যদিও ঈশ্বর কেবল একজন, তথাপি পবিত্র বাইবেল আমাদের জানতে সাহায্য করে যে, তিনি ত্রিত্ব ঈশ্বর। এর অর্থ হল তিনি তিন সত্ত¡ার মাঝে তাঁর অস্তিত্ব বিরাজমান। আরও সুক্ষভাবে জানতে হলে বলতে হয় এক ঈশ্বর নিজেকে আমাদের কাছে তিন ভাবে তিন রুপে প্রকাশ করেছেন। যথা: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর এবং পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। পুরাতন নিয়মে পিতা ঈশ্বর হিসাবে নিজেকে বার বার প্রকাশ করেছেন। নূতন নিয়মে পুত্র ঈশ্বর (যীশু) হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। পুত্র ঈশ্বর সমূদয় মানব জাতির জন্য পিতা ঈশ্বরের পরিত্রাণের কার্য শেষ করার পর স্বর্গে পিতার মহিমার দক্ষিণে উপবিষ্ট আছেন। পুত্র ঈশ্বর স্বয়ং যীশু খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আমি তোমাদের অনাথ রাখিয়া যাইব না, আমি তোমাদের নিকটে আসিতেছি- যোহন ১৪;১৮ পদ। কিন্তু সেই সহায়, পবিত্র আত্মা, যাঁহাকে পিতা আমার নামে পাঠাইয়া দিবেন, তিনি সকল বিষয়ে তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন, এবং আমি তোমাদিগকে যাহা কিছু বলিয়াছি, সেই সকল স্মরণ করাইয়া দিবেন- যোহন ১৪;২৬ পদ। পঞ্চাশত্তমীর দিনে পবিত্র আত্মা শিষ্যদের মাঝে অগ্নি আকারে নেমে এসেছিল- প্রেরিত দুই অধ্যায়ে আমরা প্রমাণ পাই। সেই পবিত্র আত্মা এখন অদৃশ্য ভাবে, আত্মায় আমাদের মাঝে বিরাজমান, হাল্লেলুইয়া, জয় যীশু।
২। যেন মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতা বজায় রাখে: প্রথম মানব জাতি তাদের অবাধ্যতা বা পাপের কারণে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সহভাগিতা হারাল। অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি হারিয়ে ফেলল। যেহেতু পিতা ঈশ্বর মানুষকে ভালবাসেন, সেহেতু সেই মানুষকে তাঁর সহভাগিতায় ফিরিয়ে আনবার জন্য পুত্র ঈশ্বরকে এই জগতে প্রেরণ করলেন, যেন মানুষ পুত্র ঈশ্বরের মধ্য দিয়ে পূনরায় পিতা ঈশ্বরের সহভাগিতায় ফিরে আসতে পারে। আর এই কারণ শাস্ত্র আমাদের কাছে প্রমাণ দেয় যে, কিন্তু ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁহার নিজের প্রেম প্রদর্শন করিতেছেন; কারণ আমরা যখন পাপী ছিলাম, তখনও খ্রীষ্ট আমাদের নিমিত্ত প্রাণ দিলেন। কেননা আমরা যখন শত্রæ ছিলাম, তখন যদি ঈশ্বরের সহিত তাঁহার পুত্রের (যীশু খ্রীষ্টের) মৃত্যু দ্বারা সম্মিলিত হইলাম, তবে সম্মিলিত হইয়া কত অধিক নিশ্চয় যে, তাঁহার জীবনে পরিত্রাণ পাইব - রোমীয় ৫;৮,১০ পদ।
প্রভু যীশুকে গ্রহণ করার পর যেন বিশ্বাসীগণ খ্রীষ্টের সঙ্গে সহভাগিতা অব্যহত রাখতে পারে, সেই জন্য মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে শেষবারের মত নিস্তার পর্ব পালন করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, “ এই পানপাত্র আমার রক্তে নূতন নিয়ম।” অর্থাৎ ঈশ্বর ই¯্রায়েল জাতিকে প্রথম যে নিয়ম দিয়েছিলেন, আর তাহা ছিল মিসরের দাস প্রথা থেকে উদ্ধার বা নিস্তারপর্ব। আর প্রভু যীশু খ্রীষ্টও সেই নিস্তরপর্ব পালন করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি সমগ্র মানব জাতির মুক্তির জন্য নিজেকে একবারই উৎসর্গ করেছিলেন যেন আর প্রতি বছর বছর নিস্তারপর্বের জন্য মেষ উৎসর্গ করতে না হয়। খ্রীষ্টের রক্তই ছিল সেই নূতন নিয়ম, যে নিয়ম চিরস্থায়ী নিয়ম হিসাবে পবিত্র বাইবেলে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কারণ খ্রীষ্ট বলেছিলেন, “ যতদিন আমি ফিরে না আইসি, ততদিন তোমরা ইহা আমার স্মরণার্থে করিও- লূক ২২;১৪-২০ পদ। যেমন কথা তেমনি কাজ, ঠিক তার পর থেকেই শিষ্যগণ এবং যতলোক পরিত্রাণ পেয়ে মন্ডলীতে যুক্ত হয়েছিল, সকলেই প্রতিদিন প্রেরিতদের শিক্ষায় ও সহভাগিতায়, রুটি ভাঙ্গায় ও প্রার্থনায় নিবিষ্ট থাকিল- প্রেরিত ২;৪২ পদ। এমনকি আজও বিশ্বের প্রতিটি মন্ডলীতে প্রভুর ভোজের মধ্য দিয়ে পুত্র ঈশ্বরের আদেশ পালনের দ্বারা পিতা ঈশ্বরের সহভাগিতা রক্ষা করে আসছে। সেই জন্য পিতা ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতার অন্যতম উপায় হল “ পবিত্র প্রভুর ভোজ ” পালন করা।
৩। যেন মানুষের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি প্রতিপলিত হয়: পবিত্র বাইবেলের একটি অংশ দিয়ে এই বিষয় শুরু করতে চাই। ১যোহন ১;৫ পদে বলা হয়েছে, আমরা যে বার্তা তাঁহার (যীশুর) কাছে শুনিয়া তোমাদিগকে জানাইতেছি, তাহা এই, ঈশ্বর জ্যোতি, এবং তাঁহার (ঈশ্বরের) মধ্যে অন্ধকারের লেশমাত্র নাই।
আবার একটি প্রশ্ন : সূর্য ও চন্দ্র, গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি কে সৃষ্টি করেছে ? উত্তরে আমরা সকলেই বলব, একমাত্র পিতা ঈশ্বরই এ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। সূর্যের দিকে আমরা তাকাতে পারি কিন্তু খুব একটা বেশী সময় ধরে নয়। কারণ সূর্যের তেজ এতো বেশী যে আমরা এক নজরে দীর্ঘ সময়ে তাকিয়ে থাকতে পারি না। ঈশ্বর মোশির সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন, কিন্তু মোশি ঈশ্বরকে দেখতে পেতেন না। তাই মোশি চিন্তা করলেন যে, আমি ঈশ্বরকে দেখব। মোশি ঈশ্বরকে কহিলেন, বিনয় করি, তুমি আমাকে তোমার প্রতাপ দেখিতে দেও। ঈশ্বর কহিলেন, তুমি আমার মুখ দেখিতে পাইবে না, কেননা মনুষ্য আমাকে দেখিলে বাঁচিতে পারে না- যাত্রা ৩৩;২০ পদ। কেবল তাহাই নয়, ঈশ্বর যখন একান্তমনে পাহাড়ের আড়ালে থেকে মোশির সঙ্গে কথা বলতেন, তখন মোশির মূখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে যেত। আর মোশি যখন পাহাড় থেকে ই¯্রায়েলে নিকটে নেমে আসতেন তখন লোকেরা মোশির নিকটে আসতে ভীত হইতেন- যাত্রা ৩৪;৩০ পদ।
এবার পিতা ঈশ্বর পুত্র ঈশ্বর হয়ে এই পৃথিবীতে নেমে এলেন যেন মানুষ ঈশ্বরকে দেখতে পায়। কারণ শাস্ত্র এই কথা বলে, “ঈশ্বরকে কেহ কখনও দেখে নাই, একজাত পুত্র,! যিনি পিতার ক্রোড়ে থাকেন, তিনিই তাঁহাকে প্রকাশ করিয়াছেন”- যোহন ১,১৮ পদ। মোশি ঈশ্বরকে দেখতে পান নি, কিন্তু ঈশ্বরের প্রতাপের কিছু অংশমাত্র দেখতে পেয়েছিল আর তাহাতেই মোশি আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। পক্ষান্তরে যীশু খ্রীষ্ট নিজের সম্পর্কেও অনেক দাবি করেছেন। তার মধ্যে তিনি প্রথমেই বলেছেন, “ আমি জগতের জ্যোতি, যে আমার পশ্চাৎ আইসে, সে কোন মতে অন্ধকারে চলিবে না কিন্তু জীবনের দীপ্তি পাইবে ’- যোহন ৮;১২ পদ।
পিতা ঈশ্বর চাইলেন যেন মনুষ্য সন্তান পুত্র ঈশ্বরের মধ্য দিয়ে পূনরায় তাঁর প্রতিমূর্তি ফিরে পায় এবং যারা অন্ধকারে জীবন যাপন করছে, তাদের মাঝে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি প্রকাশ পায় অর্থাৎ প্রতিফলন ঘটে। আর সেই জন্য খ্রীষ্টও তাঁর শিষ্যদেরকে বলেছিলেন, “ তোমরা জগতের দীপ্তি; পর্বতের উপরে স্থিত নগর গুপ্ত থাকিতে পারে না ”- মথি ৫;১৪ পদ। আজ সময় এসেছে, খ্রীষ্টের একজন উপযুক্ত সৈনিক হিসাবে জগতের কছে আমরা যেন জ্যোতি হিসাবে নিজেদেরকে প্রকাশ করতে পারি।