বর্তমান প্রেক্ষাপটে বড়দিনের বারতা

ads20

     প্রভুযীশু খ্রিষ্টের জন্ম তিথিকে আমরা বড়দিন বলে থাকি। প্রতি বত্সর ২৫ ডিসেম্বর তারিখে বিশ্বব্যাপী বড়দিন উত্সব ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্য ও পরিশীলতার মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পালন করা হয়।

    প্রভুযীশু খ্রিষ্টের জন্মের সংবাদ বিশ্ববাসীকে জানাতে গিয়ে স্বর্গদূতগণ গভীর রাতে মাঠে কর্মরত এক দল রাখালদের অতিশয় আনন্দের সহিত বলিলেন, ‘মহানন্দের সুসমাচার জানাইতেছি, সেই আনন্দ সমুদয় লোকেরই হইবে, কারণ অদ্য দায়ূদের নগরে তোমাদের জন্য ত্রাণকর্তা জন্মিয়াছেন; তিনি খ্রিষ্ট প্রভু”। তার জন্মের সংবাদ শুনে একদল দূত আনন্দে নেচে গেয়ে বললেন- উর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে (তাহার) প্রীতিপাত্র, মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি।

    আজ আমরা সত্যিই মহা আনন্দিত, কারণ অদ্য ত্রাণকর্তা, মুক্তিদাতা, পরিত্রাতা প্রভুযীশু খ্রিষ্টের শুভ জন্ম তিথি, শুভ বড়দিন। এই দিনে আজ থেকে দুই হাজার বছরের কিছু আগে বিশ্বমাতা, নারীকুল ধন্যা, মহিয়সী ও ধর্মপ্রাণ মাতা, মা মরিয়মের কোল জুড়ে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে যিহুদিয়ায় বৈেলহেম নামক দায়ূদের নগরের এক গোশালাঘরে জন্ম নিলেন স্বর্গ-মর্তের একক অধিপতি, পাপী মানুষের মুক্তিদাতা, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ, ঈশ্বঃতনয় প্রভুযীশু খ্রীষ্ট।

    প্রভুযীশুর জন্মই একটি বিরল ইতিহাস। খ্রিষ্টের জন্মের আগেই বিশ্বজননী মা মরিয়মকে স্বর্গদূতগণ ঐশীবাণীর মাধ্যমে অবগত করলেন, ‘মরিয়ম, ভয় করিও না, কেননা তুমি ঈশ্বরের অনুগ্রহ পাইয়াছ। আর দেখ, তুমি গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে ও তাহার নাম যীশু (ত্রাণকর্তা) রাখিবে।’ তাছাড়া খ্রিষ্টের জন্ম সম্পর্কে ভাববাদীগণ পূর্বেই বলেছিলেন যে, ‘দেখ, সেই কন্যা গর্ভবতী হইবে এবং পুত্র প্রসব করিবে, আর তাহার নাম রাখা যাইবে ইম্মানূয়েল’। অনুবাদ করিলে ইহার অর্থ “আমাদের সহিত ঈশ্বর”। এছাড়া যিশাইয় ভাববাদী খ্রিষ্ট জন্ম প্রসংগে লিখেন—কারণ একটি বালক আমাদের জন্য জন্মিয়াছেন, একটি পুত্র আমাদিগকে দত্ত হইয়াছেন, আর তাহার নাম স্কন্ধের উপরে কর্তৃত্বভার থাকিবে, এবং তাহার নাম হইবে- আশ্চর্যমন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ।

    খ্রিষ্টের জন্মপূবর্, জন্মক্ষ ও জন্মপর তাকে বহুনামে আখ্যায়িত করে তাকে পৃথিবীতে স্বাগত জানানো হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইম্মানূয়েল (আমাদের সহিত ঈশ্বর), ত্রাণকর্তা, মুক্তিদাতা, শান্তিরাজ, রাজাদের রাজা, সনাতন পিতা, বিক্রমশালী ঈশ্বর ইত্যাদি। তার নামের উপাধি থেকে অতি সহজেই বুঝা যায় যে, খ্রীষ্ট মানেই ঈশ্বর, খ্রিষ্টমানেই ত্রাণকর্তা, পাপী মানুষের মুক্তিদাতা, খ্রিষ্টমানেই আমাদের সহিত ঈশ্বর, খ্রিষ্ট মানেই পৃথিবীতে শান্তি, প্রেম ও ভালবাসা, খ্রিষ্ট মানেই পথ, সত্য ও জীবন, খ্রীষ্টমানেই অনন্ত জীবনের একমাত্র ঠিকানা।

    খ্রিষ্টের জন্ম কেন সমুদয় মানুষের কাছে এক মহা আনন্দের সু-সমাচার? কারণ বিশ্বের সকল পাপী-তাপী, হত-দরিদ্র, নিঃস্ব-নিপীড়িত, অন্ন-বস্ত্রহীন মানুষ, অন্যায়ের কষাঘাতে জর্জরিত, শোষিত ও বঞ্চিত এবং বন্দী মানুষ মুক্তির আলো দেখতে পেয়েছে। খ্রিষ্ট নিজেই একটি মংগল সুসমাচার। তিনি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন ও জয়গান করেছেন । অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্য তিনি পরম সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যশীলতার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ, ন্যায্যতা, সততা, পরোপকার, পরস্পরের প্রতি প্রেমের আহবান জানিয়েছেন । খ্রিষ্ট কোন একটি বিশেষ ধর্মের হয়ে প্রচার করেননি, তিনি ধর্ম নিয়ে কোন ভেদাভেদ তৈরি করে তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করেননি। খ্রিষ্টের প্রচার ছিল সমুদয় মানুষের মংগলের জন্য, মানবতার জন্য, জাতি, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে সততা ও পবিত্রতার পথে চলার আহবান। খ্রিষ্টের প্রচারের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো- কেউ এক গালে চড় দিলে আর এক গাল ফিরিয়ে দেয়া, পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করা, পরস্পর প্রেম করা, পিতা-মাতাকে সমাদর করা, প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করা, অন্নহীনকে অন্ন, গৃহহীনকে গৃহ, শীতার্তকে গরম বস্ত্র, তৃষ্ণার্তকে জল দেয়া, মন্দের দ্বারা মন্দের প্রতিশোধ না নেয়া বরং উত্তমের মাধ্যমে মন্দকে জয় করা, উপকারীর উপকার স্বীকার করা, শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই শ্রমের মূল্য পরিশোধ করা, যাহা ঈশ্বরের তাহা ঈশ্বরকে এবং যাহা জগতের তাহা জগেক দেয়া, সমস্ত অন্তঃকরণ, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত শক্তি ও সমস্ত চিত্ত দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করার আহবান। খ্রিষ্ট তার প্রচারকালে বহু আশ্চর্যকাজ সম্পাদন করেছেন- তিনি মৃতকে জীবন দিয়েছেন, অসুস্থকে সুস্থ করেছেন, অন্ধকে চোখ দিয়েছেন, পথহারাদের পথ দেখিয়েছেন। কারো প্রতি বিদ্বেষ নয় বরং সকলকে ভালবেসে, সকল ধর্ম, মত ও পথের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে সকলের মংগলের জন্যই কাজ করেছেন প্রভু যীশু খ্রিষ্ট। তিনি তার কর্মকাণ্ড কোন নির্দিষ্ট কোন গোত্র বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। কোন ভূখণ্ড, কোন রাজত্ব বা কোন চেয়ার পাওয়ার জন্য কাজ করেননি, তিনি কাজ করেছেন শান্তির জন্য, মানুষকে পাপ থেকে ফিরানোর জন্য, মানুষের মন জয় করে হূদয় সিংহাসনে আজীবন নিত্য বাস করার জন্য। তাইতো তিনি মানুষের পরম বন্ধু, তিনি সার্বজনীন, সকল মানুষের মুক্তির সনদ ।


    মানব সভ্যতা ও মানবতার ধর্ম আজ একটি সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। প্রতিদিনই আমরা বিভিন্ন ধরনের দুঃসংবাদ শুনে বিচলিত হচ্ছি, দিশেহারা হয়ে আলোর পথ হারাতে চলছি। অন্ধকারের গভীরে আমাদের শান্তির পৃথিবী নিমজ্জিত হতে চলছে। মানুষ মানুষকে ঘৃণা করছে, হত্যা করছে, ব্যভিচার করছে, আবার অনেকেই ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি ক্ষয়িষ্ণু পরিবেশের অবস্থা সৃষ্টি করে আতংককে আরো বহু মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে। এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে খ্রিষ্টের জন্ম দিন আমাদের মধ্যে শুভ বারতা নিয়ে উপস্থিত। কারণ খ্রিষ্ট মানেই শান্তি, প্রেম ও ভালবাসা।

    লেখক: পল সি মধু


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS