ঈশ্বরের রাজ্যভাবনা ও যিশু খ্রিস্টের শিক্ষা-রেভা. মার্টিন অধিকারী

ads20

     পাপে পতিত হওয়ার কারণে ঈশ্বরের ‘উত্তম’ সৃষ্টি মানুষের ওপর শয়তানের প্রচার চলে আসে। ঈশ্বরপুত্র খ্রিস্ট এই সৃষ্টির মধ্যে এলেন। লক্ষ্য, সৃষ্টিকে ঈশ্বরের কর্তৃত্বের মধ্যে ফিরিয়ে আনা। খ্রিস্টের শেখানো প্রার্থনায় আমরা ঈশ্বরের কাছে এ কথা বলি, ‘তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা স্বর্গে যেমন তেমনি পৃথিবীতেও সিদ্ধ হোক! বড়দিনের চিরায়ত বাণী এই—আমরা যেন ঈশ্বরের কর্তৃত্ব, তাঁর প্রেম, পবিত্রতা ও সামাজিক ন্যায্যতাকে আমাদের জীবনের সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আমাদের ভুল এখানে যে আমরা আত্মিক ((Spiritual) ও  ইহজাগতিক এবং বস্তুগত (Secular and material)এ দুইয়ের মধ্যে বিভেদের রেখা টানি। মূলত ঈশ্বরের সৃষ্টির সব কিছুই সুন্দর, উত্তম ও আধ্যাত্মিক।  আমাদের অহংকার, লোভ ও জগত্ এবং জীবনের প্রতি স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি ওই বিভাজনের জন্য দায়ী। ঈশ্বরের হাত থেকে শয়তানের হাতে বেহাত হয়ে যাওয়া সব সৃষ্টিকে পুনরুদ্ধার করাই ঈশ্বরের রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। স্বর্গ ও মর্ত্য সেখানে এক; কোনো দ্বৈততা (বা Dualism বা dichotomy) সেখানে থাকবে না। মর্ত্যে খ্রিস্টের আগমনের তাত্পর্য এখানেই। তাই মর্ত্যে তাঁর আগমনে আনন্দের বার্তা ছিল এই, ‘ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁর প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি’ (লুক ২: ১৪)। সাধু পৌল তাঁর পত্রে খ্রিস্টতত্ত্বের কথায় এভাবে ওই বাণীর মর্ম বুঝাতে বলেছেন, ‘ইনিই অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত; কেননা তাঁহাতেই সকলই সৃষ্ট হইয়াছে; স্বর্গে ও পৃথিবীতে, দৃশ্য কি অদৃশ্য যাহা কিছু আছে, সিংহাসন হউক, কি প্রভুত্ব হউক, কি আধিপত্য হউক, কি কর্তৃত্ব হউক, সকলই তাঁহার দ্বারা ও তাঁহার নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে; আর তিনিই সকলের অগ্রে আছেন ও তাঁহাতেই সকলের স্থিতি হইতেছে। আর তিনিই দেহের অর্থাত্ মণ্ডলীর মস্তক; তিনি আদি, মৃতগণের মধ্য হইতে প্রথমজাত, যেন সর্ববিষয়ে তিনি অগ্রগণ্য হন। কারণ [ঈশ্বরের] এই হিতসঙ্কল্প হইল, যেন সমস্ত পূর্ণতা তাঁহাতেই বাস করিয়া, তাঁহার দ্বারা যেন আপনার সহিত কি স্বর্গস্থিত, কি মর্তস্থিত, সকলই সম্মিলিত করেন, তাঁহার দ্বারাই করেন।’ (কলসীয় ১: ১৫-২০)

    খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের এ কথা বুঝতে হলে প্রয়োজন জগত্ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিকাঠামোর পরিবর্তন (paradign shift)। মণ্ডলী তথা খ্রিস্টে বিশ্বাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধিই প্রধান কথা নয়। প্রধান কথা বা বিচার্য হলো, স্বর্গীয় বা ঈশ্বরের রাজ্যের শাসন ও মূল্যবোধ কতটুকু কাজ করছে? খ্রিস্ট বলেছেন সব জগতে তাঁর ‘শিষ্য’ করতে। ঈশ্বরের রাজ্যের নিয়ম ও মূল্যবোধে প্রভাবিত হচ্ছে বা চলছে কতজন? ওই মূল্যবোধ কি পৃথিবীকে পরিবর্তিত করার সুযোগ পাচ্ছে? সীমাহীন ধর্মকর্ম বাইরে দেখা যায় কথাবার্তায় মাত্র; কিন্তু অন্তরে থাকে সেই Secularঅবস্থা। লোকদেখানো, লোকভোলানো বার্তা-বাণীর শেষ নেই। স্রষ্টা ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন এক সৃজনশীল প্রাণীরূপে, যে সৃজনশীলতার ফলে এ সংসারে সব মানুষের মধ্যে সত্যিকারের উন্নতি, শান্তি ও সম্প্রীতি হবে এবং তার মাধ্যমে ঈশ্বরের গৌরব হবে।

    সত্যি বলতে কি, যিশুর সব শিক্ষা, কাজ ও প্রচারের কেন্দ্রে ছিল ঈশ্বরের রাজ্য, অর্থাত্ সব সৃষ্টিরাজ্যে ঈশ্বরের প্রেম, সত্য ও  পবিত্রতার প্রকৃত শান্তি বা ‘শালোম’। দুঃখের বিষয় এই যে আমরা সে কথা ভুলে গিয়ে বেশি জোর দিই তথাকথিত পরিত্রাণের ওপরে, যে পরিত্রাণ এ জগতে ঈশ্বরের মঙ্গল ইচ্ছা সিদ্ধ হওয়ার কথা থেকে আমাদের সব চিন্তা-ভাবনাকে এক ‘স্বর্গ ভাবনায়’ ব্যস্ত রাখে। এ মর্ত্যের জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনের বিষয়টি আমরা ভুলে যাই। শয়তানের রাজত্ব থেকে এ জগতের রাজ্য যথাস্থানে অর্থাত্ স্রষ্টা ঈশ্বরের কর্তৃত্বে ফিরে আসবে, এটাই পবিত্র বাইবেলের মূল শিক্ষা। এ জগতে ঈশ্বরের রাজ্য যদি আমাদের জীবনের সব কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আমাদের অবস্থাটা কেমন হবে? এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।  উত্তরে এ কথা বলা যায় যে আমরা ঈশ্বরের গুণে গুণান্বিত হব। ঈশ্বরের সৃজনশীলতা, ন্যায্যতা, পবিত্রতা, সিদ্ধতা ও প্রেম নিয়ে তিনি যেমন আমরাও তাঁর মতো হব! যিশু তাঁর অনুসারীদের বলেছেন, তারা ‘জগতের দীপ্তি’ ও ‘পৃথিবীর লবণ’ যার উভয়ই পরিবর্তনসাধক ও রূপান্তরকারী।

    মানুষকে কেবল পাপের পরিত্রাণ দিয়ে তাকে কেবল স্বর্গে তুলে নেওয়ার জন্যই খ্রিস্ট মর্ত্যে আসেননি। তাঁর প্রচারের কেন্দ্রে ছিল ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ অর্থাত্ এ জগতে ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও তাঁর পবিত্র প্রেম এবং ন্যায্যতার মূল্যবোধে যেন মানুষ চলে। যিশাইয় নবীর মাধ্যমে ঈশ্বর বলেছিলেন, “কেননা আকাশমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা সদাপ্রভু, স্বয়ং ঈশ্বর, যিনি পৃথিবীকে সংগঠন করিয়া নির্মাণ করিয়াছেন, তাহা স্থাপন করিয়াছেন ও অনর্থক সৃষ্টি না করিয়া বাসস্থানার্থে নির্মাণ করিয়াছেন, তিনি এই কথা কহেন, ‘আমিই সদাপ্রভু, আর কেহ নয়।’” (যিশাইয় ৪৫: ১৮)। ঈশ্বর এ জগতেই মানুষের মধ্যে বাস করতে চান। আমরা যিশুর শেখানো প্রার্থনায় বলি, ‘তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক, যেমন স্বর্গে তেমন এ পৃথিবীতে।’ তথাকথিত পরিত্রাণের চেয়ে ঈশ্বরের রাজ্যের প্রসঙ্গকে আগে দেখতে হবে। খ্রিস্টের পরিত্রাণের তাত্পর্য বোঝা প্রয়োজন। ঈশ্বরের রাজ্য আরম্ভ করার জন্য খ্রিস্ট এ পৃথিবীতে এসেছিলেন। এ জগত্ মানে এ জগতের নিয়ম বা স্বভাব। ইহজাগতিক নিয়মনীতিতে তাঁর রাজ্য নয়; কিন্তু ঐশ্বরিক মূল্যবোধে পরিচালিত হবে সে রাজ্য। খ্রিস্টের কথা, ‘আমার রাজ্য এ জগতের নয়।’ সে রাজ্যের বৈশিষ্ট্য হবে ন্যায্যতা, ধার্মিকতা এবং দয়া ও সত্য, সিদ্ধতা এবং পবিত্রতা। এ কথা সত্য যে খ্রিস্টে সাধিত মানুষের পরিত্রাণের কাজ ও ঈশ্বরের রাজ্য—এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। খ্রিস্ট এসেছিলেন যতটা না সুসমাচার প্রচার করতে, তার চেয়ে বেশি এ জন্য যে তাঁর আগমনের কারণে জগতের পরিত্রাণের বা পাপের অধীনতা থেকে মানবের মহামুক্তির সুসমাচার প্রচারিত হবে!


    জগতে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও শাসনের বিশ্বাসই মূলত খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রীয় বক্তব্য। এটাই আমাদের তথা সব খ্রিস্টে বিশ্বাসীদের বিশ্বাসমূলক দর্শন ও স্বপ্ন বা ঠরংরড়হ। এ জগতের শেষে আমাদের তথা সৃষ্টির শেষ গতিটি কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর হলো ‘ঈশ্বরের রাজ্য’। বাপ্তাইজক যোহনের প্রচারেই আছে, ‘স্বর্গরাজ্য সন্নিকট’ হওয়ার কথা ও তার লক্ষ্যে পাপের জন্য অনুশোচনা বা  ‘মানুষের মন পরিবর্তনের’ আহ্বান। আমাদের প্রত্যেকের কাছে বড়দিনের চ্যালেঞ্জ—যেন আমরা প্রত্যেকে একজন সিদ্ধ, ন্যায়বান ও সত্ ব্যক্তিরূপে জীবন যাপন করতে সচেষ্ট হই। 

    লেখক: রেভা. মার্টিন অধিকারী


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS