আকাশে বিমান উড়তে দেখে এক বাবা তার ছেলেকে বলছিলেন, ওই বিমানে তোমার মামা আছে। বাবার কথা শুনে ছেলেটি প্রশ্ন করে বলল, বাবা, মামা এত ওপরে উঠল কিভাবে? ছেলেটির বাবা তাকে বললেন, বিমান নিচে নেমে এসে তাকে ওপরে নিয়ে গেছে। এই ছোট গল্প আমাদের বলতে চায় যে, ঈশ্বর নিজেকে এত নমিত করলেন যে, তিনি ঈশ্বর হয়েও মানববেশে ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসলেন আর মানুষকে অধঃলোক থেকে ঊর্ধ্বলোকে উন্নীত করলেন। পাপ ব্যতীত তিনি আমাদের মতোই আকারে-প্রকারে মানুষ হয়ে জন্ম নিলেন। আজ আমরা তার জন্মোৎসব পালন করছি। স্বর্গীয় দূত মানুষের জন্য এক মহাআনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছেন। স্বর্গদূত বলছেন, ‘আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছিÑ আজ দায়ুদ নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন- তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু (লুক ২:১-১৪)।’ স্বর্গদূতের দেয়া সেই আনন্দবার্তা হলো, ঈশ্বর মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিলেন এবং তিনি ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হলেন। প্রবক্তা ইসাইয়াও সেই আনন্দবার্তা প্রকাশ করে বলেছেন, তোমার সঙ্গসুখে তারা আনন্দিত। মানুষ ফসল কাটার সময় যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি তোমায় পেয়ে তারাও আনন্দিত হয় (ইসাইয়া ৯:২-৭)। সত্যি আজ আনন্দের দিন। কেননা খ্রিস্ট আজ আমাদের মাঝে এসেছেন এবং আমরা তাকে ত্রাণকর্তারূপে পেয়েছি। যারা খ্রিস্টকে লাভ করে তারা নিরানন্দে থাকতে পারে না। যারা খ্রিস্টকে লাভ করে তারা সর্বদা আনন্দিতই থাকবে। সেই আনন্দ নির্মল আনন্দ। খ্রিস্টকে পাওয়ার আনন্দ, সুসম্পর্ক ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দ, ভালবাসার আনন্দ। তার বিপরীতে দেখি কিছু মানুষ জাগতিক ও ভোগবিলাসের মাঝে আনন্দ খুঁজতে গিয়ে সুখ, আনন্দ কোনটাই পায় না। এখন আমরা নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে পারি এবং প্রশ্ন করতে পারি, আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কিভাবে আনন্দ করি, কিসের মাঝে আনন্দ খুঁজি? জগতের আনন্দ, ভোগের আনন্দ কি আমাদেরকে প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে? আমরা কি নিয়ে আনন্দ করতে ভালবাসি? যদিও ঈশ্বর আনন্দবার্তা ঘোষণা করেছেন, তথাপি অনেকের জীবনেই আনন্দ নেই কেন?
ঈশ্বর এখন আমাদের মধ্যেই আছেন। তিনি আর আমাদের থেকে দূরে নন। তিনি আর আগের মতো দূরে থেকে কিংবা আড়ালে থেকে অর্থাৎ আগুনের মাধ্যমে, মেঘের মাধ্যমে কিংবা কপোতের মাধ্যমে কথা বলবেন না। তিনি এখন সরাসরিই কথা বলবেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাই তাঁর আরেক নাম হলো ইম্মানুয়েল অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে যাতনা ভোগ করেন, কষ্টভোগ করেন, জীবনের সংগ্রাম ও সংঘাতময় সময়েও সঙ্গে থাকেন। সাধু পল তাই বলেছিলেন, কোন দুঃখ, যন্ত্রণাভোগ, অভাব-অনটন ঈশ্বরের ভালবাসা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করতে পারবে না। তিনিই আমাদের আগলে রাখবেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন এবং অনন্তকাল থাকবেন। যিশু নিজেই বলেছেন, ‘আর জেনে রাখো, জগতের সেই অন্তিম কাল পর্যন্ত আমি সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে আছি (মথি : ২৮ : ২০)।’ সেজন্য কোন কিছুতেই ভয় পাবার কারণ নেই। কিন্তু আমরা মানুষ সামান্য কিছুতেই ভয় পাই। আমরা ভয় পাই সত্য কথা বলতে, ন্যায্য কথা বলতে, ভালবাসার কথা বলতে, সেবা করতে, সাহায্যের হাত বাড়িতে দিতে। ভয় পাই সমালোচনাকে, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই মনোভাব নিয়ে সর্বদা হীনম্মন্যতায় থাকি, লজ্জা ভয়ে থাকি। আর ভয় আমাদের আনন্দকে বিনষ্ট করে দেয়। সে জন্য আজ মঙ্গলসমাচারের মাধ্যমে স্বর্গীয় দূত বলছেন, তোমরা ভয় পেয়ো না। এই অশান্তময় পৃথিবীতে তোমরা ভয় পেয়ো না- যারা অসুস্থ, অসহায়, দরিদ্র কিংবা শোকার্ত। তোমরা অন্ধকার দেখেও ভয় পেয়ো না। কারণ জগতের আলো এখন উদিত হয়েছে। মহাজ্যোতিতে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যাবে। তাই ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
যিশুর সমসাময়িক ইহুদিরা মশীহের আগমনের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল ছিলেন। তারই আগমনের কথা প্রবক্তা ইসাইয়া ব্যক্ত করেছেন। ৭৩২ খ্রিস্টপূর্বে আসিরিয়ার রাজা গালিলেয়ার বাসিন্দাদের নির্বাসিত করার ফলে উত্তর রাজ্যের লোকের অবস্থা শোচনীয় ছিল। তারা অন্ধকারে পথ চলছিল, তারা ভয়ে ভীতিতে ও অশান্তিতে ছিল। তাদের সেই অবস্থায় প্রবক্তা ইসাইয়া আশার বাণী শোনাচ্ছেন। তিনি বলছেন, শান্তিরাজ আসছেন, তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তাকে ডাকা হবে এই নামে- অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ।
স্বর্গীয় দূতদের সঙ্গীত এই অশান্তময় পৃথিবীতে, সংঘাত, দ্বন্দ্ব, সাংঘর্ষিক পরিবেশে শান্তির বার্তা নিশ্চিত করে এবং ঈশ্বরের ভালবাসা ও শান্তি ঘোষণা করে। ‘জয় ঊর্ধ্বলোকে জয়, ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত মানবের অন্তরে।’ স্বর্গদূতদের মতো আমাদেরও শান্তি ও আনন্দের গান সকলকে শোনাতে হবে। যেখানে অশান্তি, দুঃখ-কষ্ট, যেখানে বিবাদ-দ্বন্দ্ব সেখানে শান্তির দূত হয়ে শান্তি ও মিলনের বাণী শোনাতে হবে।
শান্তি ও আনন্দ কখন থাকে না? যখন আমাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করি না, ঈশ্বরের জন্য আমার হৃদয়ে যখন স্থান থাকে না, আমরা যখন দূরে সরে যাই। মঙ্গলসমাচারে বলা হয়েছে, পান্থশালায় তাদের থাকবার মতো স্থান ছিল না অর্থাৎ হড় ৎড়ড়স ভড়ৎ এড়ফ. ঈশ্বরের জন্য স্থান নেই মানে হলো গরিবের জন্য, শিশুদের জন্য, অবহেলিতদের জন্য, অসহায়দের জন্য আমাদের হৃদয়ে স্থান নেই।
স্বর্গদূতের কথা রাখালেরা শুনেছিলেন, কারণ তারা জেগে ছিল। জেগে থাকা মানে কি? জেগে থাকা মানে হলো নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা, স্বার্থপরতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে সবার মঙ্গলে সচেষ্ট ও সজাগ থাকা। তারা সচেতন ছিল। আমাদের বিবেক যখন জেগে থাকে, আমরা যখন জেগে থাকি, তখন প্রভুর বাণী শুনতে পাই এবং বুঝতে পারি। রাখালেরা বলছে, চলো আমরা বেথলেহেমে যাই। তারা দ্রুত ছুটে গেল। তার মানে হলো, ঈশ্বরকে তারা প্রথম স্থান দিল কিংবা তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈশ্বর, তাই সব কিছু ফেলে রেখে ছুটে গেল। তাদের মতো আমাদেরও যিশুর কাছে যেতে হবে। যিশুকে প্রথম স্থান দিতে হবে। তবেই যিশুকে পাওয়ার প্রকৃত আনন্দ হৃদয়ে লাভ করতে পারব।
লেখক: গৌরব জি. পাথাং