বাংলাদেশের প্রথম গির্জা ও খ্রিস্টধর্ম

ads20

    ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যিশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের অন্যতম সাধু টমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে আসেন এবং ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে সাক্ষ্যমর বা ধর্মশহীদ হন। এ সময়ের মধ্যে তিনি স্থানীয় কিছু ইহুদী, অগ্নিউপাসক ও সনাতনধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পর্তুগীজ আধিপত্যের  গোড়াপত্তন করেন। পর্তুগীজ বসতিস্থাপনকারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা বর্তমান ভারতের হুগলীর নিকটবর্তী সাতগাঁও ও চট্টগ্রামে বসবাস ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমোদন  লাভ করেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবর তাঁদেরকে বঙ্গদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পর্তুগীজ মিশনারীরা বাংলাদেশের শিক্ষা, সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থার ভিত্ প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকেন। ১৬৬৩-১৮৩৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশে খ্রিস্ট ধর্মের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে।
    বাংলাদেশের প্রথম গির্জা ও   খ্রিস্টধর্ম - The first church and Christianity in Bangladesh

    “সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার
    ঈশ্বরীপুর গ্রামে, স্থাপিত হয়েছিল-বাংলাদেশের প্রথম খ্রিস্টান গির্জা”

    ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ইগ্নেসিয়াস লয়োলা নামক একজন স্পেনিস ব্যক্তির নেতৃত্বে জেসুইট বা যিশু সম্প্রদায় গঠিত হওয়ার পর খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য খ্রিস্টানগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। পিয়ারে ডু জারিক নামক একজন ফরাসী’র  তথ্যানুযায়ী , সে সময়ে বাকলা, শ্রীপুর ও যশোহর নামে তিনটি হিন্দু রাজ্য ছিল। ফনসেকা নামক একজন খ্রিস্টান পাদ্রী নদীপথে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরে পৌছান । সেখানে তিনি অন্য একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ফাদার সোসার সাক্ষাৎপান । অত:পর ফাদার সোসও ফনসেকা প্রতাপাদিত্যের দরবার কক্ষ বারদুয়ারীতে উপস্থিত হয়ে রাজাকে বেরিঙ্গান নামের এক প্রকার সুস্বাদু কমলালেবু উপহার দেন এবং বারদুয়ারী ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে যেখানে খ্রিস্টান পল্লী অবস্থিত সেখানে একটি গির্জা নির্মাণের প্রস্তাব করেন । প্রতাপাদিত্য আনন্দের সঙ্গে এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। প্রতাপাদিত্যের ফরমান পাওয়ার পরই গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায় । ঐ সময়ে প্রতাপাদিত্যের সৈন্য বাহিনীতে বহু পর্তুগীজ সৈন্য কর্মরত ছিলেন । গির্জা নির্মাণের জন্য তারাসাধ্যমত অর্থ সাহায্য করেন । এছাড়া প্রতাপাদিত্য নিজের রাজধানীতে খ্রিস্টানদের উপাসনালয় নির্মাণের জন্য প্রভূত সাহায্য সহযোগিতা করেন । ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হয় । নাম ছিল  ÔHoly Name of Jesus’ । ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র তার ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন,  ‘ঈশ্বরীপুরের (বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর) উত্তর-পূর্ব কোণে যুধিষ্ঠির সর্দারের ভিটাবাড়ির পাশের জঙ্গলের মধ্যে ইষ্টকরাশি এক্ষণে তাহার স্থান নির্দেশ করিয়া দেয় মাত্র’।

    ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ফাদার ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ এবং এন্ড্রূ বোভস, আরকানের রাজার অর্থ সহায়তায় দ্বিতীয় গির্জাটি নির্মাণ করেন চট্টগ্রামে , যার নাম ‘Saint John the Baptist Church’. ১৬০১ সালে পর্তুগীজ মার্চেন্টগণ কর্নফুলী নদী তীরে তৃতীয় গির্জাটি নির্মান করেন , যা আরাকান আক্রমনে যা ধ্বংস হয়ে যায় । কিছু পর্তুগিজ বালক তখন  আরাকান’দের ক্রীতদাস হিসাবে কর্মরত ছিল ,  ফাদার ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ এর প্রতিবাদ করেছিলেন । আরকান’রা তখন ফাদার কে ব্যাপক মারধর করে। নির্মম ভাবে আঘাত এবং নির্যাতনপূর্বক ফাদারকে অন্ধকার ঘরে বেঁধে রাখে তারা। অতঃপর ১৪ নভেম্বর ১৬০২ তারিখে  মারা যান ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ। সেটি ছিল -বাংলার বুকে কোন খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকের প্রথম মৃত্যু।

    ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রথম পর্তুগীজ আগষ্টিনিয়ান পুরোহিতগণ খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু করেন। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নারিন্দায় একটি গির্জা নির্মিত হয় যার নাম রাখা হয় ‘Church of the Assumption’. ঢাকার ঐতিহাসিক তেজগাঁও গির্জা ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এছাড়া বর্তমান গাজীপুর জেলার নাগরীতে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকার নবাবগঞ্জের হাসনাবাদে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে এবং বরিশালের পাদ্রীশিবপুরে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি করে গির্জা নির্মিত হয়েছিল।

    বাংলাভাষা ও বাঙালি জাতির শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মিশনারি মনীষীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর নাম ড. উইলিয়াম কেরী। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতায় আসেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খুলেন এবং হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের জন্য মদনাবটিতে ১টি ও রামপাল দীঘিতে ১টি কলেজ স্থাপন করেন। তিনি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়মের গদ্য অনুবাদ করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম বাংলায় অনুবাদ করেন ও তা মুদ্রণ করেন। ড. কেরী ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একখান ছাপাখানা স্থাপন করেন ও ছাপার মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শ্রীরামপুরে একটি কলেজও স্থাপন করেন। তাঁর কর্মজীবন অবিভক্ত ভারতে খ্রিস্টধর্মের আলো প্রবর্তনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ড. কেরী ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর একজন নিবেদিত প্রাণ ধর্ম প্রচারক।

    বাংলাদেশের ক্যাথলিক মণ্ডলি  ঢাকা , চট্টগ্রাম , দিনাজপুর , খুলনা , ময়মনসিংহ , রাজশাহী ও সিলেট এই ৭টি ধর্মপ্রদেশে  বিভক্ত। বাংলাদেশে মোট  খ্রিস্টান জনগণ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ , তন্মধ্যে  সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ক্যাথলিক মন্ডলীর অন্তর্ভুক্ত । সকল বিশপগণের পক্ষে আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও ক্যাথলিক মন্ডলী বা চার্চ পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাদেশে মূলতঃ তিনিই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু।
    প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মণ্ডলি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রটেস্ট্যান্ট মণ্ডলিগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান মণ্ডলিগুলো হল- চার্চ অব বাংলাদেশ, ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, ব্যাপ্টিষ্ট ফেলোশিপ চার্চ, গারো ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, সেভেন্থ ডে এডভ্যান্টিষ্ট চার্চ, এ্যাসেম্বলীস্ অব গড চার্চ (এজি চার্চ), প্রেসবেটেরিয়ান ফেলোশিপ চার্চ, লুথারিয়ান চার্চ, প্যান্টিকষ্ট চার্চ, গসপেল চার্চ, মেথডিষ্ট চার্চ, নাজরীন চার্চ, তালিতাকুমী চার্চ, ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চ অব বাংলাদেশ, চার্চ অব ক্রাইষ্ট, রিডিম্ড চার্চ অব বাংলাদেশ  উল্লেখযোগ্য। চার্চ অব বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান হলেন শ্রদ্ধেয় বিশপ পল শিশির সরকার।


    ঢাকার আর্মেনিয় স্ট্রিটে অবস্থিত আর্মেনিয় গির্জা  ‘হলি রিজারেকশন’। গির্জাটির প্রার্থনা হলের উপরে স্থাপিত ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, গির্জাটি পূর্বের একটি চ্যাপেলের ধ্বংশাবশেষের ওপর নির্মিত হয়। এটি এবং কলকাতার আর্মেনিয় গির্জা ইচমিয়াদজিন-এর প্রধান আর্মেনিয় গির্জার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। গির্জার আদি শীর্ষ চূড়া ও ক্লক-টাওয়ারটি জোহান্স এ্যারাপিট সারকাইজ কর্তৃক ১৮৩৭ সালে নির্মিত হয়। তবে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এটি ভেঙ্গে পড়ে।


    জনসন রোডের সেন্ট টমাস অ্যাংলিকান গির্জাটি ১৮১৯ সালে নির্মিত হয় । বাইরের দিকে এর পোর্চ, খাঁজকাটা প্যারাপেট, ক্লক-টাওয়ার এবং গথিক রীতির খিলান ইংল্যান্ডের পল্লী গির্জাগুলির (parish churches) মতো। বহির্ভাগ থেকে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো গথিক রীতির জানালা সমৃদ্ধ এর সম্মুখ ভাগের দ্বিতল অবয়ব। বিশাল অভ্যন্তর হলটি অসংখ্য ভাস্কর্যে পূর্ণ। দুপাশে মাদার মেরী ও সেন্ট জন সহ ক্রুসের মাঝে বেদনাবিদ্ধ যিশুর চিত্রাঙ্কিত বেদি এবং এর পেছনে রয়েছে চক্র সদৃশ্য জানালা (rose window)। পূর্ব কোণের ছাদে স্বর্গীয় পরী ও যিশুখ্রিস্টের চিত্র অলংকৃত, যা স্বর্গের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান।


    ‘Cathedral of Our Lady of the Holy Rosary’ ক্যাথেড্রাল অব আওয়ার লেডি অব দ্য হোলি রোজারি , পাথর ঘাটা চট্টগ্রাম , ক্যাথলিক চার্চ , পর্তুগিজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ১৬০০ সালে , ব্রিটিশ’রা কর্ত্তৃক নতুন নির্মাণ সাল ১৮৪৩ এবং সংস্কার ও পুননির্মাণ ১৯৩৩ সাল।

    Holly Rosario Church হোলি রোজারিও চার্চ  তেজগাঁও ঢাকা । গির্জাটি ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় বলে ধারনা করা হয়। প্রথমদিকে এটি গির্জা ছিল না , সম্ভবত নেস্টোরীয় খ্রিস্টানগণ উপাসনার স্থান হিসেবে গির্জার পশ্চিম দিকের অংশটি নির্মাণ করেছিল । ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গির্জাটির চারবার সংস্কারের কথা জানা যায়।




    ছবি ও তথ্যঃ উইকিপিডিয়া

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS