খ্রীষ্টের জন্ম, কর্ম জীবন, মৃত্যু ও তাঁর পূনরুত্থান খ্রীষ্ট বিশ্বাসীদের জীবনে এক বিশাল গুরুত্ব বহন করে । প্রভু যীশুর কষ্টভোগ. ক্রুশারোপণ, মৃত্যু এবং কবরস্থ এ সব কিছুর পিছনে ঈশ্বরের এক বিশাল পরিকল্পনা ছিল । এর সব কিছুর সাথেই স্থানীয় লোক জন এমনকি স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত যুক্ত ছিল, এক দিকে যেমন তারা প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিল, পক্ষান্তরে শয়তান এদেরকে যীশুর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। শয়তান এও চেয়েছিল যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে যীশুর অস্তিত্বকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত করতে পারে। তাই যিহুদীদের দ্বারা প্রথম বিচার শুরু হয় । প্রথমে তাঁকে হাননের সামনে আনা হয়েছিল এবং অনেক প্রশ্ন করেছিল (যোহন ১৮:১৯-২৩ পদ) । পরবর্তীতে মহাযাজক কায়াফার সামনে নেয়া হয়েছিল, এর পরে তাঁকে মহাসভার সামনে হাজির করা হয়েছিল । এই মহা সভা হলো ই¯্রাইলীয় প্রাচীন বা বৃদ্ধ নেতাদের দলগত সভা অর্থাৎ যেখানে মহাযাজক, ফরীশী ও সদ্দূকীয়রা মহাসভা ডাকতেন (প্রেরীত ৫:২১পদ) । পরবর্তীতে রোমীয়দের মাধ্যমে তিন দফায় বিচার হয় । প্রথম রোমীয় বিচার শুরু হয় পীলাতের সামনে । তিনি ছিলেন যিহুদা রাজ্যের ৬ষ্ঠ রোমীয় শাসনকর্তা । যিহুদীনেতাগণ যীশুকে বধ করার কার্যটি পাকাপোক্তের লক্ষ্যে রোমীয় আদালতের অনুমোদন নিয়েছিল । রোমীদের দ্বিতীয় দফায় বিচার হয়েছিল হেরোদ এর সামনে। এবং তৃতীয় দফায় আবার পীলাতের সামনে । পীলাতের সবচেয়ে বড় পাপ ছিল, তিনি যা সত্য বলে জানতেন, তা তিনি তার অবস্থান, মর্যাদা ও ব্যক্তিগত লাভের আশায় আপোস করেছিলেন । পীলাত জানতেন যীশু সম্পূর্ণ নির্দোষ । কথাটি তিনি কয়েকবার ঘোষনাও করেছিলেন (যোহন ১৮:৩৮পদ, যোহন ১৯:৪-৬পদ)। শাসকগণ যীশুকে দোষী করতে গিয়ে নিজেরাই দোষী হয়েছেন । উপরোক্ত বিষয়য়ের আলোকে বোঝা যায় স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসন যীশুর কষ্টভোগ, ক্রুশারোপন, মৃত্যু এবং কবরস্ত করা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিল ।
খ্রীষ্টের মৃত্যু ও বিশ্বাসীর জীবন :
প্রকৃত খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা ভালবাসা ন¤্রভাবে ও সাহসের সঙ্গে খ্রীষ্টের প্রশংসা করে । তার জন্য যে মূল্যই তাকে দিতে হোক না কেন, যেন সকল লোকের কাছে খ্রীষ্টই ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার একমাত্র পরিত্রানের পথ রুপে প্রকাশিত হন। যীশু বলেছেন, আমিই পথ, সত্য ও জীবন । আমার মাধ্যমে না আসলে কেউই পিতার নিকটে আসতে পারে না। যীশুর মৃত্যু ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এবং একবিংশ শতাব্দির সবচেয়ে বিষ্ফেরোণকর রাজনৈতিক ঘটনা ও ব্যক্তিগত ঘটনা। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তিনি আমাদের জন্য কত লাঞ্চনা, লজ্জা ও অপমাপন সহ্য করেছিলেন। মানুষের হয়েই তিনি এই লজ্জা ও অপমান ক্রুশে বহন করেছিলেন। ঈশ্বর যীশুকে মৃতদের মধ্যথেকে উঠালেন এটা দেখাতে যে তিনি সঠিক ছিলেন ও তাঁর সকল দাবীই ছিল যথার্থ। এটা ঘটেছিল তিন দিন পর। রবিবার খুব সকালে তিনি মৃত্যু থেকে পূনরুত্থিত হলেন । তাঁর স্বর্গে চলে যাওয়ার আগে চল্লিশ দিন তিনি অসংখ্যবার তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন (প্রেরিত ১:৩পদ) । তখনকার সময়ে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত ছড়াত যে এটাছিল শিষ্যদরে দর্শন, চিন্তাভাবনার ফসল । ্এখনও অনেক অবিশ্বাসী লোক এভাবেই ব্যাখা করে থাকে। কিন্তু এমনটা যে সত্যই ঘটেছে তাঁর শিষ্যরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করলেন তারা সহজেই ফাঁদে পড়ার লোক ছিলেন না। তারা তৃণমুল স্তরের ব্যবসায়ী ছিলেন । তারা জানতেন মানুষ মারা গেলে আবার বেঁচে উঠে না । এক সাক্ষাৎকারে তাই যীশু নিজে তাদের পীড়াপীড়ি করলেন মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য, একথা প্রমান করতে যে তিনি আত্মা (ভুত) ছিলে না (লুক ২৪:৩৯-৪৩পদ)। তিনি কয়েকবারই তাঁর শিষ্যদের হাত দিয়ে ছুইয়ে দেখতে বলেছিলেন যেন তাদের বিশ্বাস ঘনিভুত হয়। এটা মৃতদেহের পুনর্জগারণ করানো ছিল না । এটা ছিল ঈশ্বর-মানবের পুনরুত্থান, এক অবিনাশী নতুন জীবন। প্রকৃত পক্ষে খ্রীষ্টের মৃত্য ও পূনরুত্থান বিশ্বাসীদের জীবনের ভিত্তি আরও মজবু করে। কেননা পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মে দেখতে পাই ইব্রীয় ভাববাদী যিশাইয়, খ্রীষ্টের জন্মের শতশত বছর আগে বলেছেন, তাকে চুর্ণ করতে সদাপ্রভুরই ইচ্ছা ছিল; তিনি তাঁকে যাতনাযুক্ত করলেন”(যিশাইয় ৫৩:১০পদ) । যীশুর জন্মের যেমন ভাববাণী ছিল, তেমনি জন্মের জন্য একজন কুমারী মেয়েকে ব্যবহার করা হয়েছিল, জন্মের সময়ে মাঠে রাখালদের দর্শণ, পূর্বদেশীয় পন্ডিতদের গণণার ফল, জন্মের পরে তাঁর বেড়ে উঠা ও পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবন যেখানে ছিল অসাধারণ ব্যতিক্রমি ঘটনাপ্রবাহ, বিবাহ বাটিতে জলকে দ্রাক্ষারস করা, রুগীকে সুস্থ করা, অন্ধকে চক্ষু দান, প্রকৃতিকে শান্ত করা, এমনকি মৃতকে জীবণ দান যা ছিল পৃথিবীর কোন রক্ত মানুষের পক্ষে অসম্ভব । কোন মানুষ তার জাগতিক জ্ঞান বা পার্থিব্য ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রকৃতিকে থামানো বা মানুষের জীবন দান করা সম্ভব নয় । সেই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করেছেন তিনি কোন ভাবেই মানুষ হতে পারেন না। এটা হলো ঈশ্বরের একটি স্বর্গীয় পদক্ষেপ যা মানুষের জন্য ব্যবহার করেছিলেন । জন পাইপার নামে এক লেখকের লেখায় দেখা যায়, কেন যীশু মৃত্যুবরণ করতে এসেছিলেন ? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি পঞ্চাশটি কারণ বের করেছেন।
আমরা কেমন ভালবাসি আমদের পুনরুত্থীত যীশুকে ?
আমরা বলে থাকি আমি জন্মগতভাবে খ্রীষ্টিয়ান , আমার বাবা আমার দাদু এই করেছেন, সেই করেছন, আমি বর্তমানে এই করছি ইত্যাদি।
আমি আমার প্রভুকে ভালবাসি, নিয়মিত গীর্জায় যাই, নিয়মিত সভা সমিতি করি। আমি বিশ্বাস করি প্রভুকে , এমন অনেক কথা আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সারে বলে থাকি। কিন্তু বাস্তবে আমি নিজে প্রভুর জন্য কি করতে পেরেছি সেটাই হলো বর কথা । এক বার এক রবিবার গীর্জা চলা কালিন সময়ে কিছু সন্ত্রাসি এসে গীর্জ ঘরের দরজায় দাড়িয়ে বন্দুক উচু করে সকল উপাসনাকারীর দিকে তাক করে ধরল। সকলেই সন্ত্রসীদের ভয়ে আন্তকিত হয়ে পড়ল, মনে মনে প্রভুকে ডাকা শুরু করল, এবং তাদের হাত থেকে কিভাবে বাচা যায় সেজন্য বিভিন্ন ভাবে অনুনয় বিনয় করা শুরু করল । কিন্তু বন্দুধারীরা দরজার কাছে মাটিতে একটি ক্রুশ রেখে বললো তোমাদের ছেড়ে দেব, আমাদের কথা তোমাদের শুনতে হবে। যে ব্যক্তি এই ক্রুশের উপর পা দিতে বাইরে বেরিয়ে আসবে সেই মুক্তি পাবে। তাদের কথা শুনে সকলেই একটু দি¦ধাদন্ধে পরে গেল। কিন্তু কি করা প্রাঁণে বেচে যাওয়ার জন্য এক এক করে সেই কাজটিই সকলেই করল, ক্রুশের উপর পা দিয়ে গীর্জা ঘড় থেকে বেড়িয়ে যাওয়া শুরু করল । এক এক করে সকলেই বেড়িয়ে গেল কিন্তু সবশেষে একটি ছোট্ট বালক গীর্জা ঘরের ভিতরে ছিল যে এই কাজটি করতে অপারগতা ¯ী^কার করল, সে বললো আমি কোন ভাবেই আমার প্রভুর গায়ে পা রেখে এই গীর্জাঘর থেকে বের হতে পারব না। তোমরা আমাকে মেরে ফেললেও আমি এই কাজ করব না । কারণ আমার প্রভু আমাকে ভালবাসেন তিনি আমাকে রক্ষা করবেন, আর যদি এই মূহুর্তে তিনি রক্ষা নাও করেন তবে আমাকে তোমরা মেরে ফেললে আমি যীশুর কাছে চলে যাব। আর তার এই বিশ্বাস দেখে দস্যুদল তাকে না মেরে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। এই গল্প আমাদের কি শিক্ষা দেয় ? দুই বন্ধুর গল্প আমরা জানি । ভাল্লুকের আক্রমন থেকে বাচার জন্য এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে ছেড়ে চলে গেল । আমাদের প্রভুকে ভালবাসি কিন্তু জাগতিক বিপদ আসলে তাকে অস্বিকার করি। কিন্তু আমাদের প্রভু তাঁর জীবন দিয়ে দিলেন, তিনি আমাদের অস্বিকার করেন নাই। তিনি এখনও ভালবাসেন। যীশু স্বর্গারোহনের পূর্বে বলেছিলেন ”শান্তি আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি, আমার শান্তি জগতের নয়। আমার শান্তি চিরস্থায়ী। তাঁর শান্তিকে এভাবে তুলনা করা যায়। মথি ১:২৬ পদে যীশু বলেছেন-’হে পরিশ্রান্ত ভারাক্রান্ত লোক সকল তোমরা আমার কাছে আইস, আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব।
পুনরুত্থানের তাৎপর্য ঃ
আমাদের প্রভু যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান বিশ্বাসীর জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ । বাইবেল ধ্যান করলে দেখা যায় প্রভু যীশুর জন্ম, জীবন কাল, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যদিয়ে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। পুরাতন নিয়মের বিধিব্যবস্থা সাধারন মানুষের জন্য পালন করা যেমন কঠিন ছিল তেমনি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে মানুষকে এক কঠিন অবস্থানে ফেলে দেয়া হতো, ব্যবস্থা নিয়েই বেশী ব্যতিব্যস্ত থাকত, ফলে মানুষ অনেক সময় ঈশ্বর থেকে দুরে সরে যেত। কিন্তু প্রভু যীশুর আগমনের এই নতুন সূচনা মানুষকে ঈশ্বরের কাছে যেতে সাহায্য করেছে। তাঁকে বাদ দিয়ে কোন কিছু কল্পনা করা যায় না। প্রভু যীশুর পুনরুত্থান বিশ্বাসীদের ভিত্তিমূল। তাই পবিত্র বাইবেল আমাদের এই সত্য শিক্ষাদেয়-- ১ করিন্থীয় ১৫:১৭পদ” আর খ্রীষ্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তোমাদের বিশ্বাস অলিক, এখনও তোমরা আপন আপন পাপে রহিয়াছ”। খ্রীষ্ট যদি উত্থাপিত না হইত তাহলে আমাদের বিশ্বাস বৃথা। সতরাং বিশ্বাসীদের এই গভীর বিশ্বসের মূলে রয়েছে প্রভু যীশুর পুনরুত্থান । ১ম পিতর ১:১৮-১৯ পদে বলা হয়েছে, তোমরা ত জান, তোমাদের পিতৃপুরুষগণের সমর্পিত অলীক--- কিন্তু নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক মেষশাবক স্বরুপ খ্রীষ্টের বহুমূল্য রক্ত দ্বারা মুক্ত হইয়াছো। মার্ক ১০: ৪৫ পদে বলা হয়েছে, কারণ বাস্তবিক মনুষ্যপুত্র পরিচর্য্য পাইতে আসে নাই, কিন্তু পরিচর্য্য করিতে এবং অনেকেরে পরিবর্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরুপে দিতে আসিয়াছেন । ঈশ্বরের বাক্য পবিত্র বাইবেল আমাদের তাঁর মৃত্যুর তাৎপর্য সম্পর্কে সুন্দর শিক্ষা দেয় । আমাদের পরিত্রান পাবার এক বিশেষ উপায় করেদিয়েছেন আমাদের প্রভু যীশু তাঁর পুনরুত্থানের মধ্যদিয়ে । তাই পবিত্র বাইবেল এই কথা বলে রোমীয় ১০:৯পদে, কারণ তুমি যদি মুখে যীশুকে প্রভু বলিয়া স্বীকার কর এবং হৃদয়ে বিশ্বাস কর যে, ঈশ্বর তাঁহাকে মৃতগনের মধ্য হইতে উত্থাপন করিয়াছেন,তবে পরিত্রান পাইবে।” কাজেই পরিত্রান বা পাপ থেকে উদ্ধার বা মুক্তির জন্য প্রভু যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু থেকে উত্থাপনই বিশ্বাসর জীবনে তাৎপর্য বহন করে ।
উপসংহার ঃ
প্রভু যীশুর জন্মের আগমনের ভবিষ্যৎবাণী, জ¥গ্রহণ, তাঁর কর্মজীবন, তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান এর সময়কার ঘটনা প্রবাহ আমদের স্মরণ করিয়ে দেয় তিনি পরাৎপর ঈশ্বর থেকে আগত এবং ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ ছিলেন এবং তিনি পৃথিবীতে আগত অন্যান্য ভাববাদী / নবী বা সাধু পুরুষ বা মহামাবদের থেকে শক্তিশালী ছিলেন, কেননা এত পরাক্রমশক্তি কারো ছিল না ও পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কারও জন্ম হয় নাই । কাজেই আমরা যাহারা বিশ্বাস করি বা খ্রীষ্টিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি তারা জানি তিনি কিভাবে এই পৃথিবীতে এসেছেন, কি কাজ করেছেন, কিভাবে তার মৃত্য হলো। কারণ আমরা দেখতে পাই প্রভু যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশীয় মৃত্যু ও পনরুত্থান আমাদের জীবনে এক অনাবিল আনন্দ, শান্তি নিয়ে এসেছে। তাঁর পনরুত্থানের মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছি । আমেন ।