আমার পরিত্রাণের জীবন
ভূমিকা :- মানব জীবনে এমন অনেক মুহুর্ত আসে যা থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণের উপায় প্রয়োজন হয়। যেমন: অশান্তি থেকে মুক্তির উপায়, আবার বিপদ থেকে মুক্তির উপায়। যে কোন সমস্যাথেকে মুক্তির উপায় হতে পারে। কিন্তু মানব জীবনে পাপ থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণের উপায় সব থেকে জরুরী। আমার জীবনেও পরিত্রাণের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আমি ছোটবেলা থেকেই এতিমখানায় পড়া-শুনা করার অপূর্ব সুযোগ পেয়েছিলাম। হোষ্টেলে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় প্রেয়ার মিটিং হত। পবিত্র বাইবেলের শিক্ষামালায় আমার জীবন পরিচালিত হয়। এমনকি যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, তখন আমি প্রথম একবার পুরো বাইবেল পাঠ শেষ করি। কিন্তু তখনও পরিত্রাণের জ্ঞান আমার আসেনি। একবার শীতকালে এক সন্ধ্যায় আত্মিক উদ্দিপনা সভায় যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। সেই সভার মূল বচন ছিল, “ কেননা পাপের
বেতন মৃত্যু, কিন্তু ঈশ্বরের অনুগ্রহ-দান আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টেতে অনন্ত জীবন- রোমীয় ৬;২৩ পদ।” প্রচারক প্রচার করছেন, পবিত্র আত্মার জীবন্ত উপস্থিতি আর বিশ্বাসীদের পদচারনায় মুখরিত সভাস্থল। প্রচারের শেষে প্রচারক আহবান জানালেন, “ যারা যারা পরিত্রাণ পাননি, দয়াকরে সামনে আসুন।” আমি তখনও বুঝতে পারিনি, পরিত্রাণের স্বাদ/আহবান কি ? সেই দিন অনেকেই সামনে এগিয়ে গেলেন, রীতিমত গান-প্রার্থনা চলছে। প্রার্থনার মধ্যে কেহ কেহ নীচে পড়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, কেউ বা সুস্থ হচ্ছে। আবার কেউ বা চিৎকার করে বলছে,‘হাল্লেলুইয়া’, কিন্তু আমি নির্বাক পিছনে বসেই আছি। যখন হোষ্টেলে ফিরে আসি, রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে আমার হৃদয়ে একটা অনুভুতি আসে, ‘আমি পাপী’, এই পাপপূর্ণ জীবন নিয়ে স্বর্গে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, আমাদের বড় স্যার রেভা: বেনেডিক্ট অমালেন্দু বাড়ৈ। তিনি একজন ঈশ্বরভক্ত, ধার্মিক এবং সমাজ সেবক হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। যদিও তিনি অনেক পূর্বেই প্রভুতে নিদ্রিত হয়েছেন তথাপিও ওনার অবদানের কথা না বললেই নয়। আমার পরিত্রাণের জীবন সুচনা
মূলতঃ ওনার হোষ্টেলে সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনের মধ্য দিয়েই আরম্ভ হয়। কিন্তু তখনও ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। চলতে চলতে এস, সি, সি পাস পরে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরে ঢাকায় চলে আসি। তখন ১৯৯৫ খ্রীঃ, মগবাজার দিলু রোডে আমার মেঝো বোনের বাসায় বেড়াতে আসি। পাশের রুমে থাকেন কলিগ্রামের প্রচারক সাইমন কুন্দার। এক সন্ধ্যায় ওনার রুমে যাই প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে। গানের সময় আমি তবলা বাজালাম, প্রার্থনা করলাম। পরের দিন, উনি ওনার অফিসে আমার বিষয়ে আলোচনা করেন, কি করতে পারেন আমাকে নিয়ে। হোষ্টেল জীবনে ঢোলকরতাল বাজানোর অভিজ্ঞতা/তালন্ত আমার ছিল। তাই ঐ দিনের তবলা বাজানো দেখে সাইমন দাদা আমার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দুর্বল হয়ে পড়েন আমার জন্য কিছু করার জন্য। অল্প কিছু দিনের মধ্যে শুরু হয় আমার ইন্টারভিউ, তারপর বাপ্তিস্মের জন্য চুরান্ত প্রস্তুতি। পালক স্বর্গীয় এন্ড্রু বিমল হালদারের শিক্ষায় পরিত্রাণের তাৎপর্য উপলব্দি করতে থাকি এবং সিদ্ধান্ত নিই আমার জীবনে খ্রীষ্টকে মুক্তিদাতা, পরিত্রাতা হিসাবে গ্রহন করা। কারণ আমার জীবনে আর কোন আশা ছিল না যে, আমি স্বর্গে যেতে পারি। একমাত্র যীশু খ্রীষ্টই আমার জীবনের পরিত্রাতা, মুক্তিদাতা। তিনি আমার পাপের জন্য তাঁর নিজের জীবন ক্রুশে উৎসর্গ করেছেন যেন আমি পরিত্রাণ পাই, পাপের ক্ষমা পাই। সেই দিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন, ১৯৯৫ সনের ৩০ শে নভেম্বর। সায়েদাবাদ মারান আথা চার্চে আমাদের বাপ্তিস্ম অনুষ্ঠান; তিনটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বাপ্তিস্ম দেওয়া হয়।
প্রশ্ন তিনটি নিম্নরূপ:
১) আপনি কি প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে ব্যক্তিগত জীবনে ত্রাণকর্তা, মুক্তিদাতা হিসাবে গ্রহন করতে ইচ্ছুক ?
২) আপনি কি মন্ডলীর সাক্ষাতে প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে প্রকাশ্যে পরিত্রাণকর্তা হিসাবে স্বীকার করেন ?
৩) আপনি কি আজ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খ্রীষ্টে আপনার জীবন পরিচালনা করবেন ?
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিলাম, হ্যা, আমি বিশ্বাস করি, স্বীকার করি এবং মৃত্যু পর্যন্ত খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত থেকেই জীবন-যাপন করব। কারণ এই জীবনে আর কারোর কর্তৃত্ব নাই, কেননা খ্রীষ্ট তাঁর অমূল্য রক্ত দ্বারা আমাকে পাপের দাসত্ব থেকে ক্রয় করেছেন। আমি আর আমার নই, কিন্তু খ্রীষ্টই আমাতে জীবিত আছেন। সুতরাং এখন থেকে খ্রীষ্টই আমার জীবনে কর্তৃত্ব করবেন। সেই দিন থেকে আমার পরিত্রাণের জীবন শুরু হয়। এর পর এক বছরের জন্য বাইবেল স্কুলে পড়াশুনার সুবর্ণ সুযোগ পাই যেন নিজেকে আরও পরিপক্ক করে তুলতে পারি। সেই সময় ছিল ১৯৯৬ খ্রীঃ গাজিপুরে অবস্থিত সি, ডি, সি-তে আমার আরেকটি স্কুল জীবন শুরু হয়। দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল, সি, ডি, সি গ্রাজুয়েসনের দিন। অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে, কোথায় যাবে, কি করবে ? কিন্তু আমার চোখে কোন কান্না নাই, অশ্রæ নাই, কারণ, ঈশ্বর
পূর্ব থেকেই আমার জন্য ক্ষেত্র নিরুপন করে রেখেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমি প্রথম এফ, সি, সি, বি-তে প্রচারক হিসাবে আহŸান পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় বেশী দিন সেখানে কাজ করতে পারি নাই। কারণ এরই মধ্যে নয়াকান্দি অধিকারী বংশ আমার জীবন দেখে চয়েস করেন যাতে করে তারা আমার সঙ্গে ওনাদের ভাগিনাকে বিয়ে দিতে পারেন। একই সাথে ঢাকায় বসবাসের সুযোগও আসে আমার জীবনে। ওদিকে গ্রামে বাড়িতে আমার মা, বড় ভাই আছেন, ঢাকায় আমার মেঝো বোন জামাই। কাউকে কোন সংবাদ না দিয়েই বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটে যাচ্ছে সব ঘটনা। বিয়ে হয়ে গেল, নতুন পরিচর্যা কাজও শুরু হয়ে যায়।আমি প্রভুর ধন্যবাদ করি যে, অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনি আমার জীবনে ‘ জ্যোৎ¯œা ’ নামের মেয়েটিকে উপযুক্ত সঙ্গিনী হিসাবে দিয়েছেন। সেও দীর্ঘদিন যাবৎ ফিনিস-ফ্রি মিশনে পড়া-শুনা করেছে, তারও বাবা নেই, আমারও নেই। কিন্তু এখন আমাদের সকলের বাবা আছেন, তিনি স্বর্গীয় পিতা। আমরা পরিবারগত ভাবে দীর্ঘ্যদিন প্রভুর পক্ষে পরিচর্যার কাজ করে আসছি। টালিথা কুমী চার্চে প্রায় পনের
বছর হোষ্টেল সুপার হিসাবে এবং বর্তমানে আমি ‘ হাউজ চার্চ অব বাংলাদেশ’ নামক মন্ডলীতে প্রভুর ‘ দাস ’ হিসাবে পালকীয় পরিচর্যা কাজে নিয়োজিত আছি।
পরিত্রাণের জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ খ্রীঃ, চলছে এবং চলবে। কারণ পবিত্র বাইবেল এই কথা বলে, “ আমি উত্তম যুদ্ধে প্রাণপণ করিয়াছি, নিরুপিত পথের শেষ পর্যন্ত দৌঁড়াইয়াছি, বিশ্বাস রক্ষা করিয়াছি। এখন অবধি আমার নিমিত্ত ধার্মিকতার মুকুট তোলা রহিয়াছে; প্রভু, সেই ধর্মময় বিচারকর্তা, সেই দিন আমাকে তাহা দিবেন; কেবল আমাকে নয়, বরং যত লোক তাঁহার প্রকাশপ্রাপ্তি ভালোবাসিয়াছে, সেই সকলকেও দিবেন- ২তীম ৪;৭,৮ পদ।” সাধুপৌল তীমথিয়কে বলেছেন, বিশ্বাসের উত্তম যুদ্ধে প্রাণপণ কর; অনন্ত জীবন ধরিয়া রাখ; তাহারই নিমিত্ত তুমি আহুত হইযাছ, এবং অনেক সাক্ষীর সাক্ষাতে সেই উত্তম যুদ্ধে প্রতিজ্ঞা স্বীকার করিয়াছ- ১তীম ৬;১২ পদ।
উপসংহার :- আমি পরিত্রাণ পেয়েছি, এটাই শেষ নয়। কারণ পরিত্রাণের জীবন কখনও শেষ হয় না, বরং চলমান থাকে। পরিত্রাণ পাওয়ার চেয়ে তা রক্ষা করা বড়ই কঠিন। আমি জীবন মুকুট পাওয়ার আশায় লক্ষের অভিমুখে দৌঁড়াইতেছি যেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত সহকারে জীবন-যাপন করতে পারি। শাস্ত্র এই কথা বলে, তুমি মরণ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাক, তাহাতে আমি তোমাকে জীবন মুকুট দিব- প্রকা ২;১০ পদ। জীবনে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যে কেহ শেষ পর্যন্ত প্রভুতে স্থির থাকিবে, সেই পরিত্রাণ পাইবে- মথি ২৪;১৩ পদ। আমি পরিত্রাণ পেয়েছি, পরিত্রাণ অর্থ হল, পাপের ক্ষমা, তৎপরে অনন্ত জীবনের নিশ্চয়তা। প্রভুযে অনন্ত জীবন আমাকে দিয়েছেন, তা ধরে রাখার দায়িত্ব আমারই। যেন শেষ পর্যন্ত তাঁহাতে বিশ্বাসে স্থির থাকি। প্রভু যীশু বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য স্থান প্রস্তুত করতে যাচ্ছি, যখন তিনি পূনর্বার ফিরে আসবেন, তখন আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যাবেন, যেন, তিনি যেখানে থাকেন, আমিও সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারি- যোহন ১৪;১-৩ পদ। আমেন
পালক কিশোর তালুকদার
বটবাড়ী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।
Nice
ReplyDelete