দানিয়েলের কাহিনী

ads20
    রাজা নবূখদ্নিৎসর যখন দানিয়েলকে তার নিজের শহর যিরূশালেম থেকে বন্দি করে বাবিলে নিয়ে আসেন তখন দানিয়েল ছিলেন মাত্র বালক। তাদের বন্দি করে আনবার পর দানিয়েল ও তার তিন বন্ধুকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবার জন্য নেওয়া হল। তাদের সকলের চেহারা ছিল খুবই সুন্দর। তারা যিহূদার সবচেয়ে ভাল পরিবারের ছেলে ছিলেন। তারা ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান।
    রাজা বললেন, ‘তিন বছরের জন্য আমার স্কুলে তাদের ভর্তি করিয়ে দাও। এখানে তাদেরকে আমাদের ভাষা শিক্ষা দাও। তারা আমাদের সাহিত্য পাঠ করুন; আমাদের চিন্তাবিদদের লেখা পাঠ করুক। আমি তাদের সবচেয়ে ভাল খাবার ও ভাল আঙ্গুর-রস দেব। আমি চাই তারা যেন সবদিক দিয়ে যোগ্য ও বুদ্ধিমান হয়।’
    ঈশ্বর তাঁর লোকদের খাবার সম্বন্ধে বিশেষ বিশেষ নিয়ম দিয়েছেন- কোন খাবার তারা খেতে পারবে আর কোনটা খাবে না সেই সম্বন্ধে নিয়ম আছে। আর দানিয়েল ও তার তিন বন্ধু ঈশ্বরের দেওয়া নিয়ম রক্ষা করতে চাইলেন। যার উপর তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব ছিল তাকে তারা বললেন যেন রাজার দেওয়া খাবারের পরিবর্তে তাদের শুধু সবজি ও জল দেওয়া হয়।
    কিন্তু পরিচালক বলল, ‘যদি তোমরা রোগা হয়ে যাও বা অসুস্থ হয়ে পড় তবে রাজা আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি মাত্র দশ দিন তোমাদের এই খাবার দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।’
    দশ দিন পর দেখা গেল যারা রাজার পছন্দের খাবার খেয়েছে তাদের চেয়ে দানিয়েল ও তার তিন বন্ধুর সাস্থ্য আরও বেশী সুন্দর ও তারা জ্ঞনে বুদ্ধিমান হয়ে উঠলেন। তারা ক্লাশেও ভাল ছাত্র ছিলেন। তাই তারা যে খাবার খেতে চেয়েছিলেন পরিচালক তাদের সেই খাবারের ব্যবস্থা করে দিল। তিন বছর পরে দানিয়েল ও তার তিন বন্ধু স্কুলের সব পুরস্কার পেলেন। তারা বাবিলের অন্য সব জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদের চেয়েও বেশী জ্ঞানী হয়ে উঠলেন। তাই রাজা তাদেরকে তার রাজ দরবারের সদস্য করে নিলেন।
    একটি স্বপ্ন
    একদিন রাতে রাজা একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন দেখে তিনি ভীষন ভয় পেলেন ও রাজ্যের সব জ্ঞানী লোকদের ডেকে পাঠালেন।
    রাজা বললেন, ‘আমি ঠিক মনে করতে পারছি না যে, আমি কি স্বপ্ন দেখেছি। আপনাদেরই বলে দিতে হবে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি এবং এর অর্থ কি।’
    জ্ঞানী লোকেরা এই কথা শুনে খুব ভয় পেলেন। তারা স্বপ্নের অর্থ ভালই বলতে পারবেন কিন্তু প্রথমে তাদের স্বপ্নটা কি তা তো জানতে হবে।
    তারা বললেন, ‘যদি আপনি আপনার স্বপ্নটা বলেন তবে আমরা তার অর্থ বলতে চেষ্টা করতে পারি।’ কিন্তু রাজা এতে রাগে জ¦লে উঠলেন।
    তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘আমি আপনাদের কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলব।’
    কিন্তু তারা বললেন, ‘আপনি যা জানতে চাইছেন তা কেউ বলতে পারবে না।’
    তারপর রাজা তার সৈন্যদের আদেশ দিলেন যেন তারা বাবিলের সব জ্ঞানী লোকদের মেরে ফেলে।
    তখন সৈন্যরা দানিয়েলকেও বন্দি করতে এল।
    দালিয়েল বললেন, ‘রাজার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিন। আমি তাকে তার স্বপ্ন ও তার অর্থ দুটিই বলে দেব।’
    দানিয়েল তার বন্ধুদের এই কথা জানালেন। তারা সকলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন যেন ঈশ্বর তাদের এই গোপন বিষয়টি জানান। তাতে রাজা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন ও তার অর্থ ঈশ্বর দানিয়েলের কাছে প্রকাশ করলেন।
    এতে রাজা দানিয়েলের ঈশ্বরকে সম্মান করতে শুরু করলেন।
    তিনি বললেন, ‘আপনার ঈশ্বর দেবতাদের ঈশ্বর। একমাত্র তিনিই এই বিষয় প্রকাশ করতে পারেন।
    সোনার মূর্তি
    কিন্তু এর কয়েকদিন পরে রাজা নবূখদ্নিৎসর তার এক দেবতার একটি সোনার মূর্তি তৈরী করলেন। এটি ছিল নব্বই ফুট উঁচু। রাজ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা- গর্ভনর, মন্ত্রী, বিচারকগণ সবাই এটির উৎসগ অনুষ্ঠনে যোগ দিল। সবচেয়ে ভাল বাদকগণ তাদের সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সেখানে গেল।
    রাজা আদেশ দিলেন, ‘যখনই বাজনা বাদকগণ তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজানো শুরু করবে তখনই সকলে উবুড় হয়ে এই মূর্তিকে প্রণাম করবে। যারা তা না করবে আমি তাদের আগুনের চুলায় ফেলে দিয়ে পুরিয়ে মরাব।’
    তাদের যেমন বলা হয়েছিল তারা সবাই তা করল- শুধু দানিয়েলের তিন বন্ধু মূর্তির সামনে মাথা নত করলেন না। তাদেরকে ধরে রাজার সামনে নিয়ে আসা হল। (দানিয়েল তখন রাজদরবারে ছিলেন)। তারা সাহসের সঙ্গেই রাজার সঙ্গে কথা বললেন।
    ‘হে রাজা, আগুনের হাত থেকে আমাদের ঈশ্বর আমাদেরকে রক্ষা করতে সমর্থ। কোন কাজই তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যদি রক্ষা নাও করেন, তবু আমরা অন্য দেবতার সেবা করব না, আপনার সোনার মূর্তিকে প্রণামও করব না।’
    এতে রাজা এমন রেগে গেলেন যে, বিরাট বিরাট আগুনের যে চুলা তৈরী করা হয়েছিল তার আগুন আরো সাতগুন বাড়িয়ে দেওয়া হল। তারপর তাদের হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনের চুলায় ফেলে দেয়া হল।
    এরপর রাজা অবাক হয়ে দেখলেন শুধু তারা তিনজন নয়- আগুনের মধ্যে চারজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছেন! চতুর্থজন দেখতে দেবতার মত!
    তিনি তাদের ডেকে বললেন, ‘বের হয়ে এস।’ তখন তিন বন্ধু বের হয়ে এলেন! তাদের হাত-পা এখন আর বাধাঁ নেই। আগুনে তাদের কাপড়-জামা এমনকি, তাদের মাথার চুল একটুও পড়ে নি। তাদের শরীরে আগুনের একটু গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না।
    রাজা বললেন, ‘যে ঈশ্বর এমন কাজ করতে পারেন সেই ঈশ্বরই সত্যিকারের ঈশ্বর । এই লোকদের বিরুদ্ধে রাজ্যের কেউ কোন কথা বলতে পারবে না!’
    বেল্শৎসরের ভোজ
    অনেক বছর পার হয়ে গেছে। নবূখদ্নিৎসর মারা গেছেন এবং বেল্শৎসর এখন বাবিল দেশের রাজা। তিনি তার সব মন্ত্রীদের জন্য একটি মহা ভোজের ব্যবস্থা করলেন। সেই ভোজে তিনি অনেক মদ খেয়ে মাতাল হলেন। তার রাজ্যের সমস্ত সম্পত্তি তিনি সবাইকে দেখাতে চাইলেন।
    তাই তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘রাজা নবূখদ্নিৎসর যিরূশালেমের মন্দির থেকে যেসব সোনা ও রুপার পাত্র এনেছিলেন তা নিয়ে এস।’ তারা দাসেরা দৌড়ে গেল তার আদেশ পালন করবার জন্য।
    রাজা নিজে ও তার অধীন মন্ত্রীরা ঈশ্বরের মন্দির থেকে আনা সেই পাত্রে মদ খেয়ে কাঠ, পাথর ও সোনা রুপার তৈরী দেব-দেবতাদের পূজা করতে লাগলেন।
    তারা যখন মদ খেয়ে মাতলামি করছেন তখন একটি হাত দেখা গেল। তারপর ঐ হাতটি দেয়ালে কি যেন লিখতে শুরু করল। এটা দেকে রাজার মুখ ভয়ে শুকনা কাঠের মত হয়ে গেল।
    তিনি আদেশ করলেন, ‘আমার সব জ্ঞানী লোকদের ডাক। যে এই লেখার অর্থ আমাকে বলে দিতে পারবে তাকে আমি প্রধান মন্ত্রী করব।’
    কিন্তু রাজার জ্ঞানী লোকদের মধ্যে কেউ এর অর্থ বলতে পারল না। তারপর রাণীর মনে পড়ল কিভাবে দানিয়েল রাজা নবূখদ্নিৎসরের স্বপ্নের অর্থ বলে দিয়েছিলেন। তাই তারা দানিয়েলকে পাঠালেন।
    রাজা দানিয়েলকে বললেন, ‘যদি এই লেখার অর্থ আমাকে বলে দিতে পারেন তবে আমি আপনাকে আমার প্রধান মন্ত্রী করব ও অনেক অর্থ-সম্পদ দান করব।’
    দানিয়েল বললেন, ‘আপনার ধন আপনারই থাকুক। আমি আপনাকে এর অর্থ বলে দেব বটে কিন্তু তা শুনে আপনি খুশি হবেন না। আপনি ঈশ্বরকে অসম্মান করেছেন। আপনি তাঁর মন্দির থেকে আনা পাত্রে মদ খেয়ে আপনার দেবতাদের পূজা করেছেন। তাই ঈশ্বর আপনার রাজত্বের আয়ু গুনে রেখেছেন। আপনার রাজ্য মিদিয়-পারস্যকে দেওয়া হবে।’
    সেই রাতেই বেল্শৎসরকে মেরে ফেলা হল। মিদিয়-পারস্যরা বাবিল দেশ ও রাজপ্রাসাদ দখল করে নিল এবং তাদের নেতা দারিয়াবসকে রাজ সিংহাসনে বসানো হল।
    দানিয়েলকে মেরে ফেলবার ষড়যন্ত্র
    পরবর্তী রাজা দারিয়াবস প্রধান তিনজন শাসনকর্তার মধ্যে দানিয়েলকে বিশেষ স্থান দান করলেন। দানিয়েল তখন বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি রাজার খুব বিশ্বস্ত ও বাধ্য ছিলেন। তিনি তখনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যেমন তিনি আগে করতেন। তিনি দিনে তিনবার নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটু পেতে যিরূশালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতেন।
    অন্য দুই শাসনকর্তারা দানিয়েলকে হিংসার চোখে দেখত ও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। কিন্তু তারা কোন্ বিষয়ে তার দোষ খুঁজে পাবে? তিনি কখনও কোন অন্যায় কাজ করেন না। যদি কোন দোষ দেবার থাকে তবে একমাত্র ধর্ম কর্মের বিষয়ে দিতে পারে।
    তাই তারা রাজাকে এমন একটি আইন করার জন্য চাপ দিল- যে আইন কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। আইনটি হল:
    ‘ত্রিশ দিনের মধ্যে কেউ কোন দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে পারবে না। যদি কেউ এই নিয়ম ভাঙ্গে তবে তাকে সিংহের খাঁচায় ফেলে দেওয়া হবে।’
    দানিয়েল জানতেন, রাজা এই নতুন আইন লিখে সেই কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু তিনি তখনও খোলাখুলি ভাবেই দিনে তিন বেলা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলছেন।
    এতে দানিয়েলের শত্রুরা খুশি হল। তারা যে ষড়যন্ত্র করেছিল তা কাজে লেগেছে দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে রাজাকে সব জানাল।
    এসব শুনে রাজা দারিয়াবস রেগে গেলেন কিন্তু এদিকে তার মনও খুব খারাপ হল। তিনি অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু দানিয়েলকে রক্ষা করবার কোন উপায় খুঁজে পেলেন না।
    সেই রাতেই অনেকগুলো ক্ষধার্ত সিংহের একটি বড় খাঁচায় দানিয়েলকে ফেলে দেওয়া হল।
    রাজা সেদিন রাতের খাবার কিছুই মুখে দিলেন না। তিনি সব রাজকীয় বাজনা বাদকদের ও যারা নেচে গেয়ে রাজাকে আনন্দ দেয় তাদের সকলকে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। রাতে তিনি একটুও ঘুমাতে পারলেন না। ভোর হতেই তিনি ছুটে গেলেন সেই সিংহের খাঁচার দিকে।
    তিনি জোরে ডাক দিলেন, ‘দানিয়েল, আপনার ঈশ্বর কি সিংহের হাত তেকে আপনাকে রক্ষা করতে পেরেছেন?’ রাজা আসলে দানিয়েলের কাছ থেকে কোন উত্তর আশা করেন নি।
    কিন্তু তিনি আশ্চর্য হলেন যখন দানিয়েল উত্তর দিলেন।
    ‘হ্যাঁ রাজন, সিংহেরা আমার কোন ক্ষতি করে নি। ঈশ্বর জানতেন আমি নির্দোষ। আমি আপনার প্রতিও কোন অন্যায় করি নি।’
    রাজা চিৎকার করে হুকুম দিলেন, ‘দানিয়েলকে তুলে আন। আর যারা তাকে দোষী বানাতে চেয়েছিল তাদের সকলকে সিংহের খাঁচায় ফেলে দাও।’
    সুতরাং দানিয়েল অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন কারণ তিনি ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতেন।
    এরপর রাজা দারিয়াবস নতুন আইন তৈরী করলেন।
    ‘আমার রাজ্যে সবাই দানিয়েলের ঈশ্বরকে ভয় করুক, যে ঈশ্বর তাকে সিংহের হাত থেকে রক্ষা করেছেন তিনিই জীবন্ত ঈশ্বর। যুগে যুগে তাঁর প্রশংসা হোক।’
    দানিয়েল ১-৬

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS