প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা পরাক্রমশালী রাজা

ads20
    পবিত্র বাইবেল অনুসারে মানবজাতির ইতিহাসে ইসরায়েলিরা ছিল ঈশ্বরের মনোনীত জাতি। যুগে যুগে ও কালে কালে ঈশ্বর বিভিন্নভাবে তাদের লালন-পালন ও সেবা-যত্ন করেছেন এবং শত্রুমুক্ত করে সর্বদা রক্ষা করেছেন (ইসাইয়া ১:২-৩)। তবে নিজেদের মধ্যকার নানা বিবাদে তারা ছিল যুদ্ধরত, বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন, এমনকি নিজ ভূমি থেকে নির্বাসিত। তাদের প্রত্যাশা ও প্রার্থনা ছিল ঈশ্বর তাদের জন্য একজন রাজা পাঠাবেন। বিবদমান ইসরায়েল জাতির কাছে প্রবক্তা ইসাইয়া এই আশার বাণীই প্রচার করেছিলেন, এক শিশু জন্ম নিয়েছেন আমাদের জন্য, তাঁর নাম ‘আশ্চর্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তি রাজ’ (ইসাইয়া ৯:৫)। ‘তিনি দেশে দেশে বিচার সম্পাদন করবেন, বহু জাতির বিবাদ মিটিয়ে দেবেন। তারা নিজেদের তলোয়ার পিটিয়ে করবে লাঙলের ফলা, নিজেদের বর্শাকে করবে কাস্তে, এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচু করবে না’ (ইসাইয়া ২:৩-৪)। তাঁর আগমনে প্রকৃতি ও সমাজেও পরিবর্তন দেখা দেবে। মরুভূমি হবে উর্বর ভূমি, বিচ্ছিন্ন-বিবাদে-বিভক্ত জাতি একত্র হবে, এমনকি ‘নেকড়ে বাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ ছাগশিশুর পাশে শুয়ে থাকবে...দুধের শিশু কেউটে সাপের গর্তের ওপরে খেলা করবে’ (ইসাইয়া ১১:৬-৮)।
    প্রবক্তা ইসাইয়া আরো বললেন, ‘তখন অন্ধের চোখ খুলে যাবে, বধিরের কান উন্মোচিত হবে। খোঁড়া মানুষ হরিণের মতো লাফ দেবে, বোবার মুখ আনন্দ-চিৎকার করবে’ (ইসাইয়া ৩৫:৫-৬)। প্রবক্তার মুখে উচ্চারিত এই আশা ও শান্তির বাণী শুনে ইসরায়েল জাতি অধীর আগ্রহ ও গভীর প্রত্যাশার পথ চেয়েছিল। দীক্ষাগুরু যোহন তাদের প্রস্তুতির আহ্বান জানান, ‘তোমরা প্রভুর আসার পথ প্রস্তুত করে রাখো, সোজা-সরল করে তোলো তাঁর আসার পথ’ (মথি ৩:৩)। সময়ের পূর্ণতায় ঈশ্বর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। ‘আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; ...আজ দাউদনগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন—তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু’ (লুক ২:১০-১১)।
    আজ বড়দিন। আজ আনন্দের দিন, মিলনের দিন, একতার দিন ও উৎসবের দিন। আজ স্বর্গরাজের তনয় আমাদের প্রেমের রাজা ও মুক্তিদাতা যিশুখ্রিস্ট জন্ম নিলেন। প্রবক্তা ইসাইয়ার ভবিষ্যদ্বাণী, দীক্ষাগুরু যোহনের সতর্কবাণী আর কুমারী মারিয়ার সম্মতির বাণীর ফলেই ‘বাণী একদিন হলেন রক্ত মাংসের মানুষ’ (যোহন ১:১৪-ক)। বাণী দেহ ধারণ করলেন। ঈশ্বর মানুষ হয়ে জন্ম নিলেন। ‘বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে’ (যোহন ১:১৪-খ)। দীনবেশে জন্ম নিয়ে তিনি পৃথিবীর দীনতাকে বরণ করে নিলেন।
    এই মহান রাজাধিরাজের জন্মসংবাদ কোনো রোমীয় শাসক বা সম্রাট, ইসরায়েলের সামন্তরাজ বা রাজা কিংবা কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি বা মন্ত্রী পাননি। কোনো ধনী মানুষ, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধর্মীয় গুরু বা রাজনৈতিক নেতা পাননি। রাজার জন্মসংবাদ সর্বপ্রথমে রাখালেরা পেয়েছে (লুক ২:১০)। দীনবেশে জন্ম নিয়ে তিনি সাধারণ, অসহায়, দুর্বল, ছোট ও গরিবের বন্ধু হয়েছেন। আমরা যারা দরিদ্র, অভাবী, অসহায়, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শ্রমিক বা রাখাল—আজ আমাদের জন্য বিশেষ আনন্দের সংবাদ।
    সাধারণ বেশে জন্ম হলেও তিনি সাধারণ নন। এই মহান রাজার জন্মের শুভ সংবাদ পেয়ে সুদূর পূর্ব দেশের পণ্ডিতরা আকাশের তারা দেখে নবরাজাকে খুঁজতে খুঁজতে বেথেলহেমে যান। শূন্য বা খালি হাতে নয়। তাঁরা সঙ্গে করে ‘স্বর্ণ পেটিকা, ধূপধুনো ও গন্ধনির্যাস’ (মথি ২:১১) উপহার হিসেবে নিয়ে যান। এই উপহার সাধারণ নয় এবং সাধারণ ব্যক্তিদের দেওয়া হয় না। এই উপহার একমাত্র সম্মানী ব্যক্তি, রাজা ও ঈশ্বরকেই দেওয়া হয়। তাই এ যাঁর জন্ম হলো তিনি অসাধারণ, সম্মানীয়, পরাক্রমশালী রাজা এবং ঈশ্বর। তাই তো স্বর্গদূতেরাও আনন্দে গেয়ে উঠলেন—‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়। ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত মানবের অন্তরে’ (লুক ২:১৪)।
    প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতার আগমন পৃথিবীতে শান্তি, একতা, মিলন ও ভালোবাসার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তাঁর জন্মের দুই সহস্র বছর পরও আমাদের সমাজে শান্তি নেই, ক্ষমা নেই, মিলন ও ভালোবাসা নেই। পারস্পরিক হিংসা, অহংকার, স্বার্থপরতা, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গি হামলা ও যুদ্ধ সর্বদা বিরাজমান।
    আজ তাঁর জন্মের শুভবারতা এই ব্যর্থতার মধ্যে সফলতার আভাস। ব্যর্থতা আসবেই, তবে সফলতাই জীবনের পূর্ণতা। তিনি হতাশা-নিরাশা, অশান্তি আর ব্যর্থতার মধ্যে আশা ও শান্তির বাণী শোনাতে এসেছেন। তাঁর আগমন আনন্দ ও পূর্ণতা দিতে। তাঁর জন্ম আজ আমাদের আহ্বান করছেন যেন হতাশা থেকে আশা, অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে আর পাপের জরাজীর্ণতা থেকে ক্ষমা, মিলন ও ভালোবাসার রাজ্যে পদার্পণ করতে পারি। পরস্পরের কাছে ও ঈশ্বরের কাছে আমরা যেন উপহার হয়ে উঠতে পারি। তবেই খ্রিস্টের জন্মোৎসব বড়দিন হবে সার্থক, সুন্দর, পবিত্র ও মিলন, সুখ ও আনন্দের।

    লেখক :ফাদার অনল টেরেন্স ডি’কস্তা,
    ধর্মযাজক, সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার
    নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS