হে পবিত্র আত্মা, তুমি নবায়ন করো সব সৃষ্টিকে!

ads20
    আজ পঞ্চাশত্তমী দিন; পেন্টিকস্ট সানডে—খ্রিস্টানদের একটি বিশেষ পর্ব। এদিনের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অনেক। যিশুখ্রিস্টের প্রথম অনুসারীরা এদিন পবিত্র আত্মা বা পাক রুহের দ্বারা অভিষিক্ত হয়েছিল। তারই প্রভাবে তারা নিজেরা হয়েছিল নতুন মানুষ, আর প্রচার করেছিল খ্রিস্টের আদর্শ ও সুসমাচার। বাইবেলে ‘প্রেরিত’ পুস্তকে এ বিষয়ের বর্ণনা আছে। পঞ্চাশত্তমী কথাটির আভিধানিক অর্থ পঞ্চাশতম, যে গ্রিক ভাষায় প্রথমে নতুন নিয়ম রচিত হয় সে ভাষায় ‘পেন্টিকস্টেস’। পুরনো নিয়মে মিসরের দাসত্ব থেকে ইসরায়েল জাতির মুক্তির পরে পঞ্চাশতম দিনে মোশির মাধ্যমে দশ আজ্ঞা প্রদানের স্মরণোৎসবের দিন ছিল এটি। এ ছাড়া এদিনে তারা শস্য উৎসব উদ্‌যাপন করত। তবে নতুন নিয়মে খ্রিস্টধর্মে এদিনের এক প্রতীকী অর্থ আছে। যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান দিন থেকে পঞ্চাশতম দিনে শিষ্যদের কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞাত পবিত্র আত্মার অবতরণ হয়েছিল।
    পবিত্র আত্মাই স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি স্রষ্টা ঈশ্বরের সক্রিয় আত্মিক উপস্থিতি। খ্রিস্টীয় ঐশতত্ত্বে পবিত্র আত্মা শুধু একটি শক্তিই নয়, তিনি ব্যক্তিসত্তাও। Holy Trinity বা পবিত্র ত্রিত্ববাদে ঈশ্বর এক; কিন্তু সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার বোধগম্য অর্থবহ প্রকাশ ও সম্পর্কের জন্যই তিনি ত্রিবিধ ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হয়েছেন। স্রষ্টা ও পিতা ঈশ্বরের স্বর্গীয় প্রেম ঐতিহাসিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে পুত্ররূপী খ্রিস্টে; আর সেই প্রেমের স্পর্শে প্রাপ্ত নতুন জীবন সফলভাবে যাপন করার জন্য চালিকাশক্তি হচ্ছে পবিত্র আত্মা। এ কথা স্বীকার্য যে জাগতিক কোনো উপমা অথবা যুক্তি দিয়ে ত্রিত্ববাদের রহস্য বোঝা যায় না। পবিত্র আত্মার রহস্যের বিষয়ে সমগ্র বাইবেলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জানা যায়। সৃষ্টির আরম্ভে ঈশ্বরের আত্মা জলধির ওপরে বিদ্যমান ছিল (আদিপুস্তক ১ঃ২ পদ)। সব অন্ধকার ও বিশৃঙ্খল অবস্থার ওপরে তাঁর ছিল কর্তৃত্ব। ঈশ্বর যখন মাটি দিয়ে মানুষকে নির্মাণ করলেন, তখন তার মধ্যে ঈশ্বর তাঁর নিজস্ব আত্মা প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার পরই নির্জীব মানুষ সজীব প্রাণী হয়। এই আত্মার শক্তিতেই নবীরা মহৎ ও আশ্চর্য কাজ সাধন করেছে। কুমারী মরিয়মের গর্ভে  যিশুখ্রিস্টের জন্ম, তাঁর সব আশ্চর্য ও পরাক্রমের কাজ এবং মৃত্যু থেকে তাঁর অলৌকিক পুনরুত্থান ইত্যাদি সবই হয়েছে পবিত্র আত্মায়। পবিত্র আত্মা তাই স্রষ্টা। তিনি সৃষ্টি করেন এবং সৃষ্টি যখন ধ্বংস ও বিনাশের পথে যায় তখন তাকে তিনি পুনঃসৃষ্টিও করেন। লোভ, হিংসা ও পাপের জটিল আবর্তে পতিত মানুষের সামনে ঈশ্বরের আত্মার আলোই নতুন জীবন ও নতুন সম্ভাবনার পথ দেখায়। ঈশ্বর আমাদের মধ্যে তাঁর আত্মার শক্তিতে কাজ করতে চান। আত্মার স্পর্শ আছে বলেই মানুষ প্রকৃত মানুষ; তার প্রভাব ছাড়া সে মাংস মাত্র। মানুষ যখন আত্মিকতার প্রভাবশূন্য হয়ে যায়, তখন তার পরিণতি হয় অশুভ। ব্যক্তিজীবন ও সমাজ তার অশুভ ফল ভোগ করে।
    দিকে দিকে সেই অনাত্মিক অশুভ শক্তি ও তার ফল ছড়িয়ে আছে। আজ জড়তা ও বস্তুবাদী তথা ভোগবাদী সভ্যতার দাসে পরিণত মানবসমাজের অনেক চিন্তা-চেতনা, আর মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, ঘৃণা ও হিংসার হলাহল বেড়েই চলছে। পুরো প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিপন্ন। আকাশ, বাতাস, জল ও স্থলের সবই মানুষের ভোগবাদী লোভ ও অহংকারের শিকার। গোটা প্রকৃতি আজ যেন বিরূপ; কারণ মানুষ যথেচ্ছ ব্যবহার করছে প্রকৃতির সব সম্পদ। নিরপেক্ষ প্রকৃতি কিন্তু যথাসময়ে তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়, আর তার ফল ভোগ করি আমরা।
    ঈশ্বর মানুষকে ক্ষমা করেন যদি মানুষ অন্যায়ের পথ পরিহার করে অনুতপ্ত হয়ে তাঁর পথে ফিরে আসে। মানুষ তার শত্রুকে কখনো কখনো ক্ষমা করে বা করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে আচরণ প্রকৃতি ক্ষমা করে না। তাই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব আজ বড় সংকটের মুখে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুিক্ত, নানা গবেষণা ও আবিষ্কার মানুষের জীবন আলোকিত করে বটে; কিন্তু তাতেই মানুষের জীবনে চরম উত্কর্ষ, বিকাশ ও সার্থকতা মেলে না। তার জন্য প্রয়োজন জাগতিকতার লোভ ও হিংসার ঊর্ধ্বে জীবন ও মানবীয় মূল্যবোধে তার রূপান্তর। ঈশ্বরের পবিত্র শক্তিতে, তাঁর আত্মায়ই তা সম্ভব। মানুষকে তাই ফিরে আসতে হবে স্রষ্টার কাছে, মনেপ্রাণে ও চিন্তা-চেতনায় তাকে হতে হবে নতুন। ভালোবাসতে হবে স্রষ্টাকে ও তাঁর পুরো সৃষ্টিকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু বিশ্বাস ও ডকট্রিন-ডগমাতেই জীবন হয় না; চাই জীবন ও সৃষ্টির প্রতি সম্মানবোধ।

    আমাদের আজকের সব প্রার্থনার মূল কথা হোক : হে পবিত্র আত্মা, তুমিই নতুন করো আমাদের জীবন, যেন যেখানে হিংসা সেখানে প্রেমের কাজ করতে পারি, যেখানে ধ্বংস বা মৃত্যু সেখানে জীবনের কথা, যেখানে অন্ধকার সেখানে আলোর কথা বলতে পারি।

    লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক
    রেভা. মার্টিন অধিকারী

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS