পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ে আসল ঘটনা কি?

ads20

    ধলপহরের উজ্জল কমলারঙা সূর্যরশ্মির প্রখরতায় আঁধার ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যাত্রাপথ থেকে, আলোর বন্যায় ভাসছে চারিদিক, গাড়ির শক্তিশালী ইঞ্জিনের আওয়াজ এড়িয়ে কানে আসছে পাখ-পাখালির জেগে ওঠার আভাস, জেগে উঠছে একে একে আমার সহযাত্রীরাও।

    মধ্যরাতে বাল্টিক সাগর তীরের ক্ষুদে দেশ এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন থেকে রওনা হয়ে সারারাত অনেক কাপ কফির সাহায্যে ঘুম তাড়িয়ে একটানা গাড়ীতে বাল্টিকের দুই দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া পাড়ি দিয়ে এখন লিথূয়ানিয়াতে। গন্তব্য উত্তর লিথূয়ানিয়ার সিউলাই শহরের ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিশ্বের বুকে একমেবাদ্বিতীয়ম এক স্থান, যাত্রাপথের চমক হিসেবে তখনো জানানো হয় নি অন্যদের এই সম্পর্কে। কাজেই পার্কিং-এ যখন পৌঁছালাম অন্য তিন সহযাত্রী সিপু ভাই, অপু, হামিদুল সদ্য ঘুমভাঙ্গা চোখ রগড়াতে রগড়াতে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল হাঁ হয়ে, গাইড বইয়ের সৌজন্যে এর ছবি অনেকবার দেখা হলেও আমিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে র‍য়লাম বিশ্বের বিস্ময়, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সদস্য লিথূয়ানিয়ার পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের পানে।

    পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ে: সে এক অবাক করা জায়গা, উঁচু নিচু কয়েকটা টিলার সমন্বয়ে গঠিত, চারপাশে সবুজের বান আর সেই টিলাগুলোর পাদদেশ থেকে শুরু করে শীর্ষ হয়ে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে ক্রুশের মিছিল! নানা আকারের, নানা বর্ণের, নানা পদার্থের- রকমারি, নকশাদার হাজার হাজার ক্রুশ।

    হাজার হাজার ক্রুশ:নকশাদার মহাকালের ঠিক কোন পর্যায়ে এই পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি, কিন্তু ইতিহাসের ঝরে যাওয়া কিছু বিবর্ণ পাতা সাক্ষ্য দেয় এর যাত্রা সম্ভবত শুরু হয়েছিল ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের দিকে। সেই সময়ে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী লিথূয়ানিয়ান শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন রাশান শাসকদের দমন পীড়নের, ফলশ্রুতিতে নিহত অনেকেরই লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনদের পক্ষে। সেই শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরাই সর্ব প্রথম মনের সান্তনা ও মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শুরু করেন সেই পাহাড়ে ক্রুশ পুতে রাখা। ফি বছর বাড়তে থাকে দর্শনার্থী ও ক্রুশের সংখ্যা, ভিনদেশী পর্যটক আর স্বদেশী লিথূয়ানিয়ানদের কাছে এক তীর্থে পরিণত হয় এই স্থান।

    কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, এর পরপরই যেহেতু লিথূয়ানিয়া পরিণত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রে, মস্কো থেকে পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্ম ও রাজনৈতিক কারণে বারংবার চেষ্টা চালিয়েছে ক্রুশের পাহাড়কে জনসাধারণের কাছে নিষিদ্ধ এলাকা করতে, নতুন করে ক্রুশ পোতা নিরুৎসাহিত করতে তারা তিন-তিনবার সমস্ত পাহাড়কে বুলডোজারের সাহায্যে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশবাসী গোপনে ঠিকই চালিয়ে যেতে থাকে তাদের কর্মকান্ড। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাশানরা পরিকল্পনা আঁটে পার্শ্ববর্তী কুলভে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বিরাটাকার জলাধার তৈরির মাধ্যমে সলিল সমাধি ঘটানোর পুরো এলাকার। সেটা বাস্তবায়নের আগেই পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। আবার তীর্থভূমি হিসেবেই বিশ্বমানচিত্রে পুনরাবির্ভাব ঘটে পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের।

    তীর্থভূমি

    তখন থেকেই নিত্য নতুন ক্রুশে ভরে উঠতে থাকে চারপাশ। ১৯৯৩ সালে পোপ ২য় জন পল আসে এই ক্রুশ মহাতীর্থে, আর সবার মতই তার ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে একটি ক্রুশ স্থান পায় এইখানে। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর বিশ্ব সম্পদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় পবিত্র ক্রুশের পাহাড়। ধারণা করা হয় বর্তমানে লক্ষাধিক ক্রুশ আছে সেইখানে আর বছরের প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে।

    লক্ষাধিক ক্রুশ

    ক্রুশের পাহাড়ের পাদদেশে পৌছাতেই বিস্ময়াভুত আমরা, কিসের ক্রুশ নেই সেখানে! ইট, কাঠ, পাথর, নানা ধরণের ধাতব পদার্থ সবই উপস্থিত। সেই সাথে নানা আকারের, সব ধরনের নকশার । কোনটা হয়ত মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আবার কোন কোনটা ১২ ফুটেরও অধিক লম্বা। শুধু যে ক্রুশের মেলা তাও নয় যীশু আর মেরীর নানা আকারের মূর্তিও সেখানে স্থাপন করেছে ভক্তরা। দেখলাম ক্রুশের সারি এক পাহাড় থেকে চলে গেছে আরেক পাহাড়ে, এমনকি সেই প্রান্তসীমা পেরিয়ে নিচের সমভূমি পর্যন্ত।

    যীশু মেরী এর মাঝেই কিছু আঁকাবাঁকা কাঠের পাটাতন বিছানো পথ তৈরি হয়েছে পরিদর্শনকারীদের জন্য। কোন কোন বৃহদাকৃতির ক্রুশের উপর ঝুলছে ছোটখাট শখানেক ক্রুশ! এত সকালেই আমাদের মত বিদেশীদের দেখে ফোকলা হাসি দিল বৃদ্ধা কেয়ারটেকার। এমন অদ্ভুত জায়গায় আসিনি এর আগে কেউই, কেমন যেন মন খারাপ করা নির্জনতায় মোড়া, গুরুগম্ভীর ভৌতিক আবহে ডুবে থাকা।

    বৃহদাকৃতির ক্রুশ


    অবশেষে পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ে অবস্থানকালীন সময়ে প্রয়াত পোপ ২য় জন পলের কথাটি স্মরণ করে লিথূয়ানিয়ান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিউলাই শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল আমাদের- Thank You, Lithuanians, for the hill of Crosses which testifies to the nations of Europe and to the whole world the faith of the people of this land. (ধন্যবাদ তোমাদের, লিথূয়ানিয়ানরা, এই পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের জন্য, যা ইউরোপের জাতি গোষ্ঠী এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে এই ভূখণ্ডের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাসের পরিচয় দিচ্ছে )

    যদিও সেই দেশের বন্ধুদের সাথে মিশে আমার কাছে মনে হয়েছে এই ক্রুশের পাহাড় ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশী প্রচার করে একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, স্বকীয়তা নিচে বাঁচার আকুতি আর অত্যাচারিতের রুখে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা।


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS