প্রণাম, উপহার এবং সুসমাচার

ads20

    ভূমিকা: আমাদের মানব জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্বদিন বা অনুষ্ঠান আছে। ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের খ্রীষ্টিয় জীবনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্বদিন রয়েছে। এর মধ্যে ‘ জন্মদিন ’ পর্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আমরা কোন না কোন উপহার সঙ্গে করে নিয়ে যাই। আর এই জন্ম দিন পালনের রীতিনীতি ঠিক কখন শুরু হয়েছে, সে বিষয় খুব ভাল ধারণা না থাকলেও পবিত্র বাইবেল আমাদের কাছে দিনের আলোর মতো পরিস্কার করে প্রমাণ করে যে, আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্মের পর থেকেই ‘ জন্মদিন ’ পালন করা এবং উপহার দেওয়ার বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই-ই নয়, জন্মের বারতা ঘোষণা জন্য স্বর্গ থেকে এক দূত রাখালদের কাছে নেমে এসেছিল।

    রাখালদের কাছে সুসমাচার: স্বর্গীয় দূত রাখালদের কাছে কেন খ্রীষ্টের জন্মের বারতা নিয়ে এসেছিল ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে অনেক পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। যাকোবের সন্তানেরা মেষ চড়াইতো, তাই তারা মেষ চরানোর জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিভ্রমণ করে বেড়াইতো। কিন্তু যাকোবের ছোট ছেলে তখনও তাঁর কাছেই থাকতো। কেননা যাকোব তাঁর অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে ছোট ছেলে যোষেফকে অধিক প্রেম করিতেন। কিন্তু যাকোব যখন দেখলেন, তাঁর ছেলেরা অনেক দিন হয় ফিরে আসছে না; তখন ছোট ছেলেকে তাঁর বড় ভাইদের খোঁজ-খবর নিতে পাঠালেন। যোষেফ পিতার বাধ্য সন্তান, তাই সে তাঁর বড় ভাইদের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। যোষেফ প্রান্তরে প্রান্তরে পরিভ্রমণ করতে করতে অবশেষে শিখিমে এসে উপস্থিত হন। এমন সময় একজন লোক তাঁহাকে (যোষেফকে) সে অবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করেন, কিসের অন্বেষণ করিতেছ ? সে কহিল, আমার ভ্রাতৃগণের অন্বেষণ করিতেছি, অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন, তাঁহারা কোথায় পাল চরাইতেছে। উত্তরে সেই ব্যক্তি বলিল, তাহারা এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে, কেননা “ চল, দোথনে যাই ” তাহাদের এই কথা শুনিয়াছিলাম। পরে যোষেফ ঐ লোকের কথা মতো আপন ভাইদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া ‘ দোথনে ’ তাহাদের খোঁজ পাইলেন- আদি ৩৭;২-১৭ পদ। সুতরাং ইহা খুবই সুস্পষ্ট যে, স্বর্গীয় দূত রাখালদের কাছে খ্রীষ্টের জন্মের বারতা নিয়ে এসেছিল যেন তারা সমুদয় দেশে এবং বিভিন্ন স্থানে সেই সুসংবাদ ছড়িয়ে দিতে পারে।

    সু-সমাচার : ঠিক এর পর পরেই স্বর্গীয় এক বৃহৎ দল ঐ দূতের সঙ্গি হইয়া ঈশ্বরের স্তব গান করিতে করিতে কহিতে লাগিল, ‘ উর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি ’- লূক ২;১০-১৪ পদ। এখানে আমরা দেখতে পাই স্বর্গের দূত খ্রীষ্টের জন্মের সুসংবাদ রাখালদের নিকট প্রচার করেছিল এবং বলেছিল, এই আনন্দ সমুদয় লোকেরই হইবে। দূতের উক্ত কথা অনুসারে সেই আনন্দের সুসমাচার যদি আমি, আমরা প্রচার না করি, তাহলে কিভাবে সমগ্র মানব জাতি খ্রীষ্টের কথা জানবে ?

    আমাদের ঠিক মনে আছে যে, প্রভু যীশু তাঁর মহান আদেশে কি বলেছিলেন ? তিনি বলেছিলেন, “ তোমরা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার কর- মার্ক ১৬;১৫ পদ। সুতরাং আজ যে প্রভু আদেশ করেছেন, সেই প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্মের সুসমাচার প্রচার করা আজ আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

    প্রণাম: শিশু যীশুকে দেখবার জন্য পূর্বদেশ হইতে কয়েক জন পন্ডিত যিরুশালেমে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, যিহুদীদের যে রাজা জন্মিয়াছেন, তিনি কোথায় ? কারণ আমরা পূর্বদেশে তাঁহার তারা দেখিয়াছি ও তাঁহাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি। ---------- তারাটি দেখিতে পাইয়া তাঁহারা মহানন্দে অতিশয় আনন্দিত হইলেন। পরে তাঁহারা গৃহ মধ্যে গিয়া শিশুটিকে তাঁহার মাতা মরিয়মের সহিত দেখিতে পাইলেন, ও ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। এখানে এই একটি কথা না বললেই নয়; আর তা হল, ‘ পৃথিবীর মধ্যে যাদের বু্িধমান, বিজ্ঞ ও জ্ঞানী বলা হয়, তাঁহারাই একটি শিশুকে প্রণাম করবার জন্য ছুটে এসেছিলেন!’ নি:সন্দেহে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ফিলিপিয় ২;৯,১০ পদে বলা হয়েছে, “ এই কারণ ঈশ্বর তাঁহাকে অতিশয় উচ্চপদান্বিতও করিলেন, এবং তাঁহাকে সেই নাম দান করিলেন, যাহা সমুদয় নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; যেন যীশুর নামে স্বর্গ মর্ত্য পাতালনিবাসীদের সমুদয় জানু পাতিত হয়। অর্থাৎ এই শিশু-যীশুই যে সেই রাজা, যিনি সমুদয় মানব জাতিকে বিচার করবেন, তখন সমুদয় মানব জানি খ্রীষ্টের সামনে নত হয়ে জানু পাতবে। কেননা পবিত্র বাইবেল আমাদের এই কথা বলে যে, পিতা কাহারও বিচার করেন না, কিন্তু সমস্ত বিচার ভার পুত্রকে দিয়াছেন- যোহন ৫;২২ পদ। আর সেই কারণেই পৃথিবীর বুদ্ধিামান ও বিজ্ঞ এবং পন্ডিতেরা সেই সময় পূর্বদেশ হইতে আসিয়া প্রথমে যীশুকে আন্তরীক ভাবেই প্রণাম করে শুভ সূচনা করেছিলেন।

    উপহার: আমাদের দেশের সাধারণ নিয়ম অনুসারে জন্ম দিনে নিমন্ত্রিত হই এবং প্রত্যেকেই কম-বেশী উপহার নিয়ে আসি। বিশেষত: বিশেষ কোন আত্মিয়-স্বজন হলে তো কথাই নাই, নামী-দামি উপহার না নিলে সম্মান থাকবে না। অথবা আমি সবার চেয়ে দামি উপহারই দিব, এমন মনোভাবও আমাদের মধ্যে কাহারও কাহারও আছে। পবিত্র বাইবেলে আমরা দেখতে পাই একজন শিশুকে দর্শন করবার জন্য পূর্ব দেশ থেকে কয়েক জন পন্ডিত এসেছিলেন। অনেক খুঁজা-খুঁজির পর অবশেষে শিশু যীশুকে দেখতে পাইলেন। দেখা মাত্রই শিশু যীশুকে প্রথমে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন; প্রণাম করেই তারা ক্ষান্ত হন নাই। তারা তাদের ধনকোষ খুলে শিশু যীশুকে তাদের মহা মূল্যবান সামগ্রী স্বর্ণ, কুন্দুরু ও গন্ধরস উপহার দিয়ে যথাযথ সম্মান ও ভক্তি জানালেন- মথি ২;১১ পদ। পন্ডিতদের দেওয়া উপহারের বিষয়টি নিগূঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে বিচার দিনের বিষয়ে যীশু খ্রীষ্টের দেওয়া তিনটি দৃষ্টান্তের মধ্যে একটিতে। যেখানে দক্ষিণ দিকে স্থিত লোকদিগকে খ্রীষ্ট বলেছেন, আইস, আমার পিতার আশীর্বাদ পাত্রেরা। জগতের পত্তনাবধি যে রাজ্য তোমাদের জন্য প্রস্তুত করা গিয়াছে, তাহার অধিকারী হও। কেননা আমি ক্ষুদিত হইয়াছিলাম, আর তোমরা আমাকে আহার দিয়াছিলে। পিপাসিত হইয়াছিলাম, আর আমাকে পান করাইয়াছিলে; ----------বস্ত্রহীন হইয়াছিলাম, আর আমাকে বস্ত্র পড়াইয়াছিলে; ---------- আর আমার নিকটে আসিয়াছিলে। তখন ধার্মিকেরা উত্তর করিয়া বলিবে, প্রভু, কবে আপনাকে ক্ষুদিত দেখিয়া ভোজন করাইয়াছিলাম, কিন্বা পিপাসিত দেখিয়া পান করাইয়াছিলাম ? ------------ তখন রাজা উত্তর করিয়া তাহাদিগকে বলিবেন, আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, “ আমার এই ভ্রাতৃগণের- এই ক্ষুদ্রতমদের- মধ্যে এক জনের প্রতি যখন ইহা করিয়াছিলে, তখন আমারই প্রতি করিয়াছিলে- মথি ২৫;৩১-৩৬ পদ। সুতরাং প্রতি বছর ঘুরে-ফিরে ‘ বড়দিন ’ আমাদের জীবনে আসে; বড় দিনে আমরা একে-অন্যকে উপহার দিয়ে থাকি; যেন যীশু খ্রীষ্টের জন্যও উপহার থাকে।

    উপসংহার: স্বর্গীয় দূত রাখালদের কাছে সুসংবাদ পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, এই আনন্দ সমুদয় লোকের। পন্ডিতগণ আন্তরীক ভাবে খ্রীষ্টকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, সমস্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি পাওয়ার যোগ্য একমাত্র খ্রীষ্ট। স্বয়ং খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদের আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার কর। সাধু পৌল করিন্থিয় মন্ডলীর কাছে দৃঢ়তার সঙ্গে সাক্ষ্য দিয়া বলেছেন, ধিক্ আমাকে, যদি আমি সুসমাচার প্রচার না করি! তাহলে এবারের বড় দিনে যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বারতা/সুসমাচার প্রচার করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে এই জগতে যারা ক্ষুদ্রতম, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজন, এমন একজনের জন্য উপহার স্থির করে রাখি। তাহলেই এবারের বড় দিন পালন করা হবে সার্থক এবং আশীর্বাদের। ঈশ্বর আমাদের সকলকে অযাচিত আশীর্বাদ দান করুন, আমেন।

    লেখক:পাষ্টর কিশোর তালুকদার


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS