বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রতিদিনই কোন না কোন দিবস থাকেই। সেটি হতে পারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবে, আবার পরিবারগত ভাবে। আজ বিশ^ বাবা দিবস, তারিখের হিসাবে নয়, বারের হিসাবে জুন মাসের তুতীয় রোববার। যান্ত্রিক এই জীবনে বাবার কথা কি একবার আলাদাভাবে মনে পরে আমাদের ? কাজের ফাঁকে একবার কি থমকে গিয়ে ভাবি, কেমন আছেন আমাদের বাবা, কিভাবে কাটছে তাঁর অবসর, সারা বেলা ?
বাবা দিবসের সূচনা ঃ- মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয় ১৯০৯ সাল থেকে। মায়ের প্রতি ভালবাসা থেকে যখন মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয়, তখন সোনোরা স্মার্ট ডড নামে একটি মেয়ে বাবা দিবস উদ্যাপনের কথা ভাবেন। ১৯১০ সালের ১৯শে জুন যুক্তরাষ্ট্্েরর ওয়াশিংটনের স্পোকারে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হয় “বাবা দিবস”। কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ তখন দিনটি স্বীকার করে নিতে পারেনি। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্কে “বাবা দিবস উদ্যাপন কমিটি গঠিত” হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ভাবে বাবা দিবস উদ্যাপন শুরু হয়।নির্দিষ্ট ভাবে ঃ-১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন রাষ্ট্রীয় ভাবে দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেন। সেইথেকেই প্রতি বছরের জুন মাসের ৩য় রোববার “বিশ^ বাবা” দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
জাগতিক বাবা সম্পর্কে কিছু ভাবা/জানা/শেখা ঃ- ইতিহাসের ঘেরাটোপ থেকে আবার একটু বাস্তবে
ফেরা যাক। “বাবা” মাত্র দুই বর্ণের শব্দ। অথচ এই শব্দের মধ্যে আছে নির্ভরতা, আছে গভীরতা। বাবার পায়ের ওপর পা রেখে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখা। এর পর বাবার হাত ধরেই স্কুল-কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয় পরিমন্ডল চেনা। সব কিছুতেই বাবার আধিপত্য। জীবনে প্রথম চাকুরী পেয়ে মনে পরেছিল বাবার মূখখানা। বাবাকে নিয়ে ইতিহাসে আছে নানা উদাহরণ। ইন্দিরা গান্ধীর সামনে বিশ^ ইতিহাস জানার দরজা খুলে দিলেন তো বাবা নেহেরু।বাবার জন্য সাহিত্যে স্তুতি আছে ঢের। ঘুরে আসা যাক সেই সাহিত্যের জগৎ থেকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তো বলেছেন, “জ্ঞানী বাবা সেই জন, যিনি তাঁর সন্তানকে জানেন”। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতে, “বাবা” - এই শব্দটার যতটুকু পবিত্রতা, তা তো ঈশ^রই দিয়ে রেখেছেন।ওয়াল্ড ভিশন অব বাংলাশের তথা ঃ- সন্তানদের শাসনের ধারা পুর্ব থেকে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানদের মারা যাবে না।ওয়াল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ তথা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যে সকল প্রতিষ্ঠান শিশুদের নিয়ে কাজ করছে, তাদের সংবিধানে বর্ণিত আছে শিশুদের বেত বা লাঠি দিয়ে মারা যাবে না। এমনকি শারিরীক ভাবে কোন নির্যাতন/শাস্তি দেওয়া যাবে না। যাতে করে তাঁদের মেধা বিকাশে কোনরুপ প্রভাব না পরে। উন্নত বিশে^ এই নীতি অনেক পূর্ব থেকেই পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও এই নীতি আছে। কিন্তু তাহা মানছেন না অনেকেই। অনেকে বলেন, আমার সন্তানকে আমি শাসন করব, তাতে আপনার কি ?শিক্ষার হার যতই বৃদ্ধি হউক না কেন আমাদের দেশে এখনও এমন অনেক মা-বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের লাঠি দিয়ে আঘাত করেন এবং শারিরীকভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু পবিত্র বাইবেল এই ধরণের শাস্তি বা শারিরীক নির্যাতনের কোন কথা বলে না।
আমি যত লোককে ভালবাসি, সেই সকলকে অনুযোগ করি ও শাসন করি,* অতএব উদ্যোগি হও,
ও মন ফিরাও- প্রকা ৩;১৯ পদ। অনেকে মনে করতে পারেন যে, ঈশ^র কেবল ভালবাসার, অনুগ্রহের, দয়ার, ক্ষমা এবং আশীর্ব্বাদের ঈশ^র। কিন্তু পবিত্র বাইবেল সে কথা বলে না। আমার বয়স যখন ৬-৭ মাস, তখন আমাদের দেশে মুক্তি যুদ্ধ চলছিল। ইতিপুর্বে আমার বাবা প্রভুতে নিদ্রিত হন। বাবার ভালবাসা পাইনি, বুঝিও নাই। কিন্তু এখন বাবা হয়েছি। বাবা হিসাবে সন্তানকে শুধু ভালবাসার মধ্য দিয়ে বড় করতে চাই। সন্তান যতই দিন দিন বড় হয় ততই যেন একটু একটু অবাধ্য, চঞ্চল আর দুষ্ট হচ্ছে। তখন একটু একটু করে শাসন করতে থাকি। কারণ পবিত্র বাইবেলে হিতোপদেশের অনেক জায়গায়ই সন্তানদের শাসনের কথা লেখা আছে। যেমন ঃ- হিতো ১৩;২৪ পদে, যে দন্ড না দেয়, সে পুত্রকে দ্বেষ করে, কিন্তু যে তাহাকে প্রেম করে, সে সযতেœ শাস্তি দেয়। হিতো ২৩;১৩,১৪ পদে, বালককে শাসন করিতে ত্রুটি করিও না; তুমি দন্ড দ্বারা তাহাকে মারিলে সে মরিবে না। তুমি তাহাকে দন্ড দ্বারা প্রহার করিবে, পাতাল হইতে (মৃত্যু/ধ্বংস) তাহার প্রাণকে রক্ষা করিবে।
যেহেতু আমরা সকলে এক পিতার সন্তান সেহেতু পিতা ঈশ^রের দৃষ্টিতে আমরাও যখন অপরাধ করি,তখন তিনিও আমাদের শাসন করেন। তবে ঈশ^রের শাসন ব্যবস্থা একটু ভিন্ন। তাঁর শাসন ব্যবস্থা হল “দশ আজ্ঞা”। পবিত্র বাইবেলে যাত্রা ২০ অধ্যায়ে এই ব্যবস্থার কথা লেখা আছে। এর মধ্যে ৬ ও ৭ নম্বরে আছে, নরহত্যা করিও না, ব্যভিচার করিও না। সাধু দায়ুদ এই দুটি আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিলেন। ঈশ^রও তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তবে তা ছিল তাঁর বাক্যের মাধ্যমে। যেহেতু দায়ুদ তখন রাজা ছিলেন, তাই ঈশ^র ভাববাদী নাথনকে পাঠিয়ে দিলেন এবং দায়ুদের নিকট একটি গল্প বললেন, যে গল্পের মাধ্যমে ঈশ^র তাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তুমি নরহত্যা ও ব্যভিচার করেছ। দায়ুদ যখন বুঝতে পালেন যে, সত্যিই তিনি অন্যায়/অপরাধ করেছেন, তখন তিনি ঈশ^রের নিকট তাঁর অপরাধের কথা স্বীকার করলেন এবং মন্দতা থেকে ফিরে আসলেন। তথাপিও ঈশ^র তাঁর এই মনের মত লোকটিকে শাস্তি দিলেন। তার স্ত্রী বৎসেবার গর্ভের সন্তান মারা গেল- ১ম শমূয়েল ১২;১৪-২১ পদ। এভাবে ঈশ^র তাঁর সন্তানদের শাসন করেন। ঈশ^রের শাসন কিভাবে আমাদের জীবনে ঘটে তাহা আমরা দায়ুদের জীবন থেকে বুঝতে পারি। এছাড়াও পবিত্র বাইবেলে আরোও অনেক উদাহরণ আছে তাঁর মনোনীত সন্তানদের সঠিক পথে জীবন-যাপনের জন্য ঈশ্বরের দেওয়া শাসনের কথা।যদিও ঈশ^র এই দায়ুদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি যিশয়ের পুত্র দায়ুদকে পাইয়াছি, সে আমার মনের মত লোক, সে আমার সমস্ত ইচ্ছা পালন করিবে- প্রেরিত ১৩;২২ পদ। এখানে বলে রাখি যে, গীত ২৩ অধ্যায়ের পাঁচনী হলো শাস্তি এবং যষ্ঠি হলো ঈশ^রের বাক্য। আমরা যখন ঈশ^রের আবাধ্য হই, তখন আমরা আমাদের জীবনে নানা বিধ সমস্যার সম্মূখীন হই। কিন্তু আমরা কোন মতে বুঝতে পারি না যে, এই অবস্থা আমাদের অবাধ্যতার জন্যই ঘটছে। আর একটু গভিরে যাই, হারান ছেলে যখন বাবার অবাধ্য হয়ে চলে গিয়েছিল, তখন তাঁর জীবনে চরম অবনতি নেমে এসেছিল। ঠিক তার পরেই সে যখন তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিল এবং সেচ্ছায় বাবার নিকটে ফিরে এসেছিল, পাপ/ভুল স্বীকার করেছিল, তখন তাঁর জীবনে আবার সুখ-শান্তি ফিরে পেয়েছিল-লূক ১৫;১১-৩২ পদ। কারণ ঐ পুত্র অভাবে পরে, কষ্টে পরে, অন্যের দ্বারা শাসিত হয়ে তার ভুল বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমরা অনেকে আমাদের ভুল বুঝতে পারি না, কারণ আমরা আত্মিক ভাবে অন্ধ।
উপসংহার ঃ- আমরা ঈশ^রের যতই মনের মতো লোক হই না কেন, সমাজে আমার পরিচিতি-সুনাম যতই থাকুক না কেন, আমার যতই টাকা-পয়সা থাকুক না কেন, আমার বংশ পরিচয় যাইই হউক না কেন, আমার জনবল যতই থাকুক না কেন, ঈশ^রের নিকট কোন আশ্রয়-প্রশ্রয় নাই। এই কারণ পবিত্র বাইবেল এই কথা বলে যে,“কেননা ঈশ^রের কাছে মুখাপেক্ষা নাই- রোমীয় ২;১১ পদ।”পবিত্র মন্ডীৈতে কে আমার ভাই, কে আমার বোন, কে আমার আতিœয় সেটি বড় বিষয় নয়, কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ডিসিপ্লিন/নিয়ম অর্থাৎ শাসন সকলের ক্ষেত্রে সমান হওয়া চাই। আমি যদি আমার মত করে বিচার করি, সেটি হবে সেচ্ছাচারিতা। আর এই সেচ্ছাচারিতার উপরে এক জন আছেন, তিনি আমাদের সকলের বাবা/পিতা। তিনি ক্রোধে ধীর ও দয়াতে মহান এবং পাপের ক্ষমাকারী তথাপিতিনি ন্যায় বিচারক,ঈশ^রের নিকট সকলেই সমান। তিনি কারোর সঙ্গে সমঝোতা করেন না। সে যেই-ই হউক না কেন, অবাধ্য হলে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। ফিরে যাই পূর্বের কথায়,“আমি যত লোককে ভালবাসি, সেই সকলকে অনুযোগ করি ও শাসন করি,* অতএব উদ্যোগি হও, ও মন ফিরাও ”- প্রকা ৩;১৯ পদ। ঈশ^র তিনি আমাদের সকলের একমাত্র আদর্শ বাবা। তিনি আমাদের মঙ্গল কামনা করেন বিধায়, তিনি আমাদের ভালবাসেন বিধায়, তিনি আমাদের শাসন করতে ত্রুটি করেন না, আমেন।
পাষ্টর কিশোর তালুকদার
হাউজ চার্চ অব বাংলাদেশ, ঢাকা
২১শে জুন ২০১৫ খ্রীঃ