মানব জাতির পাপ থেকে মুক্তির জন্য এই হ্যাপী ইস্টার

ads20

     ইস্টার সানডে বা পুনররুত্থান পার্বণ খ্রীষ্টধর্মাবম্বীদের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। পুনরুত্থান পার্বণকে পাস্কা পার্বণও বলা হয়। খ্রীষ্টিয় ধর্মানুশীলনে পুনররুত্থান পার্বণ বা ইস্টার সানডে প্রতি বছর ফিরে আসে ধর্মীয় চেতনা নিয়ে। খ্রীষ্ট ধর্মের প্রর্বতক যীশু খ্রীষ্ট ক্রুশে মৃত্যুবরণ করার ৩ দিন পর পুনরুত্থান করেন। এ জগতে মৃত্যু থেকে জীবিত হওয়া সম্ভব হয়েছিলো একমাত্র প্রভু যীশু খ্রীষ্টেরই পক্ষে।

    পবিত্র বাইবেলে আমরা পাই “মানবপুত্রকে প্রধান যাজক ও শাস্ত্রীয়দের হাতে তুলে দেয়া হবে; তারা তাঁকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করবেন ও বিজাতীয়দের হাতে তুলে দিবেন। তারা তাঁকে বিদ্রুপ করবে, তাঁর মুখে থু থু দিবে, তাঁকে কষাঘাত করবে ও হত্যা করবে আর তিনদিন পর তিনি পুনরুত্থান করবেন।”পবিত্র বাইবেল (নতুন নিয়ম) মার্ক: ১০ অধ্যায় ৩৩-৩৪ পদ।

    মৃত্যু তোমার জয় কোথায়, মৃত্যু তোমার হুল কোথায়। একমাত্র খ্রীষ্ট মৃত্যুকে জয় করেছেন। যীশু খ্রীষ্ট পাথর ও গাছের সমাহারে একটি স্থান গেৎসিমানী বাগানে গিয়েছিলেন প্রার্থনা করতে। যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশীয় মৃত্যুর আগের এই ঘটনা। সেখানে প্রার্থনায় মগ্ন ছিলেন যীশুর ১২ জন শিষ্য। যীশুর প্রচার কাজে তিনি ১২ জন শিষ্যকে নিয়েছিলেন। এই শিষ্যদের নিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন, পিতা ঈশ্বরের কথা বলেছেন, বলেছেন মানবতা, প্রেম, ক্ষমা, ভালবাসা ও সেবার কথা। তিনি তাঁর চলমান প্রচারকাজে অনেক আশ্চর্য কাজ করেছেন। অন্ধকে দৃষ্টিদান, খঞ্জকে সুস্থ, মৃত্যকে জীবনদান, ক্ষুধার্তদের আহারদানসহ অনেক কিছু যা করেছেন তিনি পিতা ঈশ্বরের শক্তিতে।

    মানব জাতির মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রীষ্ট এ জগতে এসেছিলেন যেন এ জগতের মানুষ তাদের আদি পাপ থেকে মুক্তি পায়। মানুষ যেন সৃষ্টিকর্তা পিতা ঈশ্বরকে ভক্তি করে তাঁকে ভুলে না যায় । তাঁর প্রশংসা করে। প্রভু যীশু খ্রীষ্ট তাঁর জীবদ্দশায় মানুষকে ভালোবেসেছেন যেন মানুষের  মধ্যে জেগে উঠে পিতা ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

    আমরা সবাই স্বীকার করি এ জগতের মানুষের কাছে সত্যের কথা, ন্যায়ের কথা, সৃষ্টিকর্তাকে ভক্তির কথা বলে গেছেন প্রভু যীশু খ্রীষ্ট। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বার বছর আগে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে প্রভু যীশু খ্রীষ্ট এ জগতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন গোশালায়। যিনি সমগ্র মানবের মুক্তিদাতা তিনি জন্মেছিলেন দীন বেশে। এটাই পিতা ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনা তাঁর সৃষ্ট মানুষের জন্য। প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্ম পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে, “আজ দাউদ নগরীতে তোমাদের জন্য এক ত্রাণকর্তা জন্মেছেন তিনি খ্রীষ্ট প্রভু।”

    পবিত্র বাইবেল (নতুন নিয়ম) লূক ২ অধ্যায় ১১ পদ।

    যীশু খ্রীষ্টের জন্মবারতা মাঠের রাখালদের জানানো হয়েছিলো। পবিত্র বাইবেলে আছে “দেখ কুমারীটি গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করবে; আর লোকে তাঁকে ইন্মানুয়েল বলে ডাকবে; নামটির অর্থ হলো আমাদের সঙ্গে ঈশ্বর।”

    পবিত্র বাইবেল (নতুন মিয়ম) মথি: ১ অধ্যায় ২৩ পদ।

    পিতা ঈশ্বর যীশু খ্রীষ্টকে এ জগতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে। মানব জাতির আদি পিতা-মাতা আদম ও হবা এদেন উদ্যোনে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে পিতা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে বিতাড়িত হয়ে এ জগতে এসেছিলেন। পিতা ঈশ্বর মানুষকে (আদমকে) শাপ দিলেন যা আমরা আদিপুস্তকে পাই,  “যে গাছের ফল সম্বন্ধে তোমাকে বলেছিলাম তুমি তা খাবে না, তোমার স্ত্রীর কথা শুনে তুমি তার ফল খেয়েছো বিধায় তোমার কারণে ভূমি অভিষিক্ত হোক। তোমার সমস্ত দিন ধরে তুমি ক্লেশেই তা ভোগ করবে। এই ভূমি তোমার জন্য কাঁটাগাছ ও শিয়ালকাটা ফলাবে, মাঠের উদ্ভিদ হবে তোমার খাদ্য। তুমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই আহার করবে যতদিন না তুমি মাটিতে ফিরে যাও। যেহেতু মাটি থেকেই তোমাকে তুলে নেয়া হয়েছে; কেননা তুমি ধূলো আর ধূলাতেই আবার ফিরে যাবে।”

    পবিত্র বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) আদিপুস্তক: ৩ অধ্যায় ১৭-১৯ পদ।

    প্রভু যীশু খ্রীষ্ট ক্রুশীয় মৃত্যুর মাধ্যমে এ জগতের মানুষকে আদি পাপ থেকে মুক্তি দিলেন। তাইতো তিনি মুক্তিদাতা। পিতা ঈশ্বর জগতকে এমন প্রেম করলেন তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে পাঠালেন যেন মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করে অনন্ত জীবন লাভ করে।

    একবার যীশু খ্রীষ্ট তাঁর ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে রাতের ভোজে বসেন। সেই ভোজকে বলা হয় লাস্ট সাপার বা শেষ ভোজ। এই ভোজের কদিন পরই যীশুকে ধরিয়ে দেয়া হয় শত্রুর হাতে। বিশিষ্ট শিল্পী মাইকেল এঞ্জোলো তাঁর তুলির টানে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই দৃশ্যপট যা ভাটিকান চার্চে আজও দৃশ্যমান। শেষ ভোজে যীশু শত্রুর হাতে ধরা পরবেন বিষয়ে বলেছিলেন। “যে আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে,আমার সঙ্গে টেবিলের উপর তার হাত রয়েছে, সেই অনুসারে মনুষ্যপুত্র চলেই যাচ্ছে, কিন্তু ধিক সেই মানুষকে, যার দ্বারা মনুষ্যপুত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো।” পবিত্র বাইবেল (নতুন নিয়ম) মথি: ২২ অধ্যায় ২১-২২ পদ।

    উপরোক্ত বাইবেলের বাক্যটি যীশু শেষ ভোজে বলেছিলেন। তখন শিষ্যরা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছিলো এবং যুদাস বলেছিলো আমি কি সেই…প্রভু। নতুন নিয়মের ৪টি পুস্তকে, মথি, মার্ক, লূক ও যোহনের সুসমাচারে প্রভু যীশুর প্রচার জীবনের বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এছাড়া পবিত্র বাইবেলের ২টিা ভাগ পুরাতন নিয়ম (যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগের ঘটনা আদম-হবা, মানুষের বংশবৃদ্ধি, ভাববাদী দ্বারা মানুষকে সতর্ক করা, নূহের জলপ্লাবন, মশির দশ আজ্ঞা, রাজা দাউদ ও নতুন নিয়ম যীশু খ্রীষ্টের জন্ম, প্রচার জীবন, ক্রুশীয় মৃত্যু ও খ্রীষ্ট ধর্মের সূচনা )

    যীশুকে ধরে নিয়ে যাওযার পর সৈন্যরা যীশুকে মারধর করে ভারী ক্রুশটি কাঁধে বহন করতে বলে। সৈন্যরা চাবুক দিয়ে যীশুকে আঘাত করে মাথায় দেয় কাঁটার মুকুট। এতো অত্যাচার, অপমান সহ্য করে তিনি অবিচল ছিলেন, পিতা ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করবেন। কালভেরী পর্বতে সৈন্যরা যীশুকে ক্রুশে দেয়। যীশুর হাতে পায়ে পেরেক মেরে তাঁকে ক্রুশে ঝুলিয়ে দেয়। সেই সময়ে মানুষকে শাস্তিস্বরূপ ক্রুশে দেওয়া হতো। তখনকার সময়ে যাদের ক্রুশে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত, সমাজ ব্যবস্থায়  তাদের মৃত্যু ছিল  সবচাইতে নিকৃষ্টতম পন্থার মৃত্যুদন্ড। এইরূপ মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের পরিবারকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হত। দুই জন চোরকে যীশুর সাথে ক্রুশে দেয়ার অর্থ ছিল যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুকে আরো অপমানিত করা। যীশুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করেছিল  ‘যীশু’ ক্রুশীয় মৃত্যুকে ভয় পেয়ে আশ্চর্য কাজের দ্বারা নিজেকে মুক্ত করবেন,  যা রাষ্ট্রের রায়ের বিপক্ষে যাবে।

    ক্ষুধা, তৃষ্ণায়, কাতর হয়ে কষ্টের মধ্যে যীশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুতে ফরিসীরা ও সৈন্যরা আশ্চয্য হলো। তারা মনে করেছিলো আরেকটি আশ্চয্য কাজ করে যীশু অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রেহাই পাবেন। যীশুর মৃত্যুর পরে তাঁকে গুহায় রাখা হয়। তখনকার দিনে পাথরের গুহার মধ্যে মৃতদের রাখা হতো। তিন দিন পর রবিরার ভোরে যীশু পুনরুত্থান করেন। যীশু জেগেছেন। এটাই ইস্টার বা পুনরুত্থান পার্বনের মূল স্মৃতি। পৃথিবী সৃষ্টি, মশি, দাউদসহ অনেক ঘটনা) এবং নতুন নিয়ম (প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্ম, প্রচার জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থান, স্বর্গারোহন এবং খ্রীষ্ট মন্ডলীর যাত্রা)। সমাজে ষড়যন্ত্রকারীরা যতই শক্তিশালী হোক, সত্য প্রকাশিত হবেই। দেশে, সমাজে, কাজে – কর্মে ও জীবনে সত্যের জয় অবশ্যই হবে একদিন। যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশীয় মৃত্যুর সময় যারা উচ্ছাস ও আনন্দ প্রকাশ করেছিল,  তারা তাঁর গৌরবময় পুনরুত্থানের পর অবাক হয়ে যায় ও শাস্ত্রের কথা, ভাববাদীর কথা ফলে যাওয়ায় অনুধাবন করে তারা ন্যায়ের পক্ষে ছিল না।

    যীশু খ্রীষ্টের প্রচার জীবন এবং আশ্চর্য কাজ এরপর ক্রুশীয় মৃত্যু, পুনরুত্থান, শিষ্যদের সাথে আবার দেখা দেয়া, ৪০ দিন অবস্থান ও শিষ্যদের আশীর্বাদ দানের মাধ্যমে এ জগতে খ্রীষ্টমন্ডলী বা চার্চের যাত্রা শুরু হয়। গেৎসিমানী বাগানে যীশু খ্রীষ্ট প্রার্থনা করার পর যীশুকে যুদাস নামের এক শিষ্য ধরিয়ে দেয়। সে যীশুর গালে চুম্বন করে। তৎকালীন সম্রাট সিজারের সৈন্যরা যীশুকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। সেই সময় পিতর নামের অপর এক শিষ্য তার তলোয়ার বের করে একজন সৈন্যের কান কেটে দেয়। যীশু বিচ্ছিন্ন কানের অংশটি নিয়ে ঐ সৈন্যের কানে পুনঃজোড়া লাগিয়ে দেন। এসময় যীশু বলেনÑ তোমার তলোয়ার খাপে রেখে দাও, যে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেছো তুমিও তদ্রুপ তলোয়ারের আঘাত প্রাপ্ত হবে। বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখি যে সকল সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তারা  অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু বরণ করে। প্রতিপক্ষের অস্ত্রের আঘাতে তাদের জীবন হারিয়ে যায়!

    আমাদের দেশে পুনরুত্থান পার্বণ উদ্যাপনের ৪০ দিন আগে থেকে মন্ডলীতে বা চার্চে তা পালন করা হয় ত্যাগ ও প্রার্থনার মাধ্যমে। প্রতি শুক্রবার পালিত হয় উপবাস। এই সময় ত্যাগ ও ক্ষমাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। যে কোন খ্রীষ্টভক্ত এই অনুশীলন পারিবারিকভাবে পালন করে থাকে। শুক্রবার থাকে বিশেষ প্রার্থনা যা ক্রুশের পথ নামে পরিচিত। এভাবে পালনের মাধ্য দিয়ে চলে আসে ইস্টার সানডে। অর্থাৎ ত্যাগ ও ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে নিজকে পরিশুদ্ধ করে খ্রীষ্টকে অন্তরে গ্রহণ করা। ইস্টার সানডে পালনের আগে ঐদিন রাতে থাকে প্রার্থনা। শুক্রবার অর্থাৎ পুণ্য শুক্রবার বা গুড ফ্রাইডে পালিত হয় উপবাস ও বিশেষ প্রার্থনায়। যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশীয় মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করা হয় এদিনে। পুণ্য শনিবার আত্মশুদ্ধির দিন। প্রস্তুতির দিন এবং অবশেষে আসে ইস্টার সানডে বা পুনরুত্থান রবিবার। মানব জাতির আদি পাপ থেকে মুক্তির সেই দিন হ্যাপী ইস্টার।

    লেখক: এলড্রিক বিশ্বাস


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS