পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বর ভক্তগণের অনেক সাক্ষ্য আছে যাহা আমাদের খ্রীষ্টিয় জীবনে চলার পথে পাথেয় হয়ে আছে। কিন্তু এমন একজন ব্যক্তি আছেন যার সাক্ষ্য পবিত্র বাইবেলের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল আছে। আজ আমরা তারই বিষয়ে আলোচনায় আলোকপাত করতে চাই যাহা আমাদের আত্মিক জীবনকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
পবিত্র বাইবেল পাঠ ঃ- ২রাজা ৫;১-১৫ পদ।
ই¯্রায়েলের ঈশ্বর ঃ- যাকোব তাঁর বড় ভাই এষৌর সহিত পুনর্মিলনের প্রাক্কালে ঈশ্বরের নিকট বিনীত প্রার্থনা জানিয়েছিলেন যেন তিনি তাঁর ভাইয়ের নিকট অনুগ্রহ প্রাপ্ত হন। ঈশ্বর যাকোবের প্রার্থনা শুনলেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। সেই জন্য যাকোব পদ্দন্-অরাম হইতে আসিয়া ; কুশলে কনান দেশের ‘ শিখিমে ’ উপস্থিত হইয়া নগরের বাহিরে তাম্বু স্থাপন করেন। পরে শিখিমের পিতা যে হমোর, তাহার সন্তানদিগকে রৌপ্যের একশত কসীতা [মূদ্রা] দিয়া তিনি আপন তাম্বু স্থাপনের ভূমিখন্ড ক্রয় করিয়া তথায় এক যজ্ঞবেদি নির্মাণ করিয়া তাহার নাম “ এল ইলোহে ই¯্রায়েল ” [ঈশ্বর, ই¯্রায়েলের ঈশ্বর] রাখিলেন- আদি ৩২;১৮-২০। ঠিক এরপর থেকেই ঈশ্বর লোকদের নিকট ‘ ই¯্রায়েলের ঈশ্বর ’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। যদিও ঔ ঘটনার পূর্ব রাতে ঈশ্বর এক বিশেষ ঘটনার অবলম্বনে যাকোবকে ‘ ই¯্রায়েল ’ নামে আখ্যায়িত করেন।
কুষ্ঠ নামানের পরিচয় ঃ- নামান, অরাম রাজের সেনাপতি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি মহান ও সম্মানিত লোক ছিলেন। কারণ ঈশ্বর এই নামানের দ্বারাই অরাম রাজাকে বিজয়ী করেছিলেন। তিনি একজন বলবান বীর ছিলেন বটে কিন্তু তিনি ‘ কুষ্ঠ ’ রোগী ছিলেন। যখন এই অরামীয়েরা দলে দলে ই¯্রায়েল দেশে এসেছিল, তখন তারা ই¯্রায়েল দেশ থেকে একটি ছোট বালিকাকে বন্দি করে এনেছিল। পরে ঐ বালিকাটি সেনাপতি নামানের স্ত্রীর গৃহের পরিচালিকা হয়।
কুষ্ঠ রোগ ঃ- পবিত্র বাইবেলের দৃষ্টিকোন থেকে আমরা বিভিন্ন ধরণের ‘ কুষ্ঠরোগ ’ সম্পর্কে জানতে পারি। লেবীয় ১৩ ও ১৪ অধ্যায়ে কুষ্ঠরোগের প্রকারভেদ লক্ষ্যনীয়। সমস্ত কুষ্ঠরোগই ধর্মিয় ভাবে অশুচি ছিল। তাই ধর্মিয় আচার-অনুষ্ঠানে তারা যোগদান করতে পারত না। তাদেরকে কঠিন শুচিকরণ রীতিনীতি দেওযা হয়েছিল। এর মধ্যে ‘ ক্ষয় করা ছাৎলা ’ নামে কুষ্ঠ বিশেষ ভাবে পরিচিত- লেবীয় ১৪;৩৩-৪২ পদ। আবার নতুন নিয়মে দেখা যায় যে, যীশু খ্রীষ্টের কাছে দশজন কুষ্ঠরোগী এসেছিল যারা দুরে দাঁড়িয়ে যীশুর নিকট বিনতি প্রার্থনা করেছিল যেন তিনি তাদের সুস্থ করেন- লুক ১৭;১১-১৯ পদ। নিঃসন্দেহে ইহা সুস্পষ্ট যে কুষ্ঠ অশুচি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই তাদেরকে থাকতে হত। কিন্তু ‘ কুষ্ঠ নামানের ’ কুষ্ঠ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা বা ব্যতিক্রমী। কুষ্ঠরোগী হয়েও তিনি একজন সেনাপতি হিসাবে তখনও তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।
ছোট মেয়ের অবদান ঃ- ই¯্রায়েল দেশ থেকে আনিতা সেই ছোট মেয়েটি নিশ্চয় এতদিন মনে মনে চিন্তা করেছে যে, আমার প্রভু একজন বলবান বীর, সেনাপতি, সম্মানিত এবং ঐ দেশের একজন মহান ব্যক্তিত্ব। ওনার কি নাই, সবই তো আছে, সব কিছু থাকা সত্বেও ওনার প্রকৃত সুখ নাই যা আমাদের সকলের আছে। তাই সে একদিন সাহস করে তার কত্তৃর কাছে বলেই বসল, ‘ আহা! শমরীয়ায় যে ভাববাদী আছেন, তাঁহার সহিত যদি আমার প্রভুর সাক্ষাৎ হইত, তবে তিনি তাঁহাকে কুষ্ঠ হইতে উদ্ধার করিতেন- ৩ পদ। কারণ ইতিমধ্যে ঐ বালিকা তার নিজ দেশে থাকিতে ভাববাদী ইলিশায়ের কৃত অলৌকিক কাজে কথা সে দেখেছে এবং শুনেছে। তাই সে নীরব থাকতে পারে নাই।
অতপর এই কথা শুনার পর কুষ্ঠ নামান রাজার নিকট যান এবং সেই ছোট বালিকা যা যা বলল, সমস্ত কথা রাজাকে খুলে বললেন। তখন রাজা কোন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা না করেই অনতিবিলম্বে ই¯্রায়েলের রাজার নিকট পত্র দিয়া নামানকে পাঠাইয়া দেন। কুষ্ঠ নামানও এই রোগ থেকে আরোগ্য হওয়ার জন্য তখনকার রীতিনীতি অনুসারেই উপহার সঙ্গে লইয়া ই¯্রায়েল দেশে রওয়ানা হলেন। নিয়ম অনুসারে রাজার মধ্য দিয়াই যেতে হইত, তাই তিনি প্রথমে রাজার কাছে গিয়ে পত্রখানি হস্তান্তর করেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়, পত্রখানি পাঠ করেই রাজা তাঁর নিজের বস্ত্র ছিড়িলেন এবং কহিলেন, ‘ মারিবার ও বাঁচাইবার ঈশ্বর কি আমি ? ’
ভাববাদী ইলিশায় ঃ- রাজা বস্ত্র ছিড়িয়াছেন ইহা শুনিতে পাইয়া ঈশ্বরের লোক ইলিশায় রাজার নিকট এই কথা বলিয়া পাঠাইলেন, আপনি কেন বস্ত্র ছিড়িলেন ? সেই ব্যক্তি আমার কাছে আইসুক, তাহাতে জানিতে পারিবে যে, ই¯্রায়েলের মধ্যে একজন ভাববাদী আছে। অতএব নামান আপন অশ্বগণের ও রথসমূহের সহিত আসিয়া ইলিশায়ের গৃহের সামনে এসে উপস্থিত হন। তখন ইলিশায় একজন দূতের দ্বারা বলে পাঠাইলেন, ‘ আপনি গিয়া সাত বার যর্দনে ¯œান করুন, আপনার নুতন মাংস হইবে, ও আপনি শুচি হইবেন।
কুষ্ঠ নামানের প্রতিক্রিয়া ঃ- কুষ্ঠ নামান মনে আশা নিয়ে ছুটে এসেছেন যে ঈশ্বরের লোক অবশ্যই তার কাছে আসবেন, তাকে বিশ্রামের জন্য বসতে বলবেন। আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর নামে ডাকিবেন এবং আমার ক্ষতস্থানে হাত দোলাইয়া কুষ্ঠ হইতে আমাকে উদ্ধার করিবেন! অথচ তিনি তা না করে আমাকে আদেশ করলেন যর্দনে গিয়া ডুব দিতে, তাহা আবার এক বার নয়, দুই বার নয়, সাত বার! তাই নামান ক্রুদ্ধ হইয়া চলে গেলেন। নামান আরও বললেন, ই¯্রায়েলের সমস্ত জলাশয় হইতে দম্মেশকের অবানা ও পর্পর নদী কি উত্তম নয় ? আমি কি তাহাতে ¯œান করিয়া শুচি হইতে পারি না ? আর তিনি মূখ ফিরাইয়া ক্রোধের আবেগে প্রস্থান করিলেন।
দাসদের ভূমিকা ঃ- কিন্তু তাঁহার দাসেরা নিকটে আসিয়া নিবেদন করিল; পিতা, ঐ ভাববাদী যদি কোন মহৎ কর্ম করিতে আজ্ঞা দিতেন, আপনি কি তাহা করিতেন না ? তবে ¯œান করিয়া শুচি হউন, তাঁহার এই আজ্ঞাটি কি মানিবেন না ? অতপর কুষ্ঠ নামান তাঁর দাসদের বিনতীর কাছে হেরে গেলেন।তিনি নামিয়া গিয়া ঈশ্বরের লোকের আজ্ঞানুসারে ‘ সাত বার যর্দনে ডুব দিলেন।’ তাহাতে ক্ষুদ্র বালকের ন্যায় তাঁহার নূতন মাংস হইল, ও তিনি কুষ্ঠ হইতে শুচি হইলেন।
যর্দন নদী ঃ- পবিত্র বাইবেলে অনেক নদী আছে কিন্তু ‘ যর্দন ’ নদী বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। যখন ঈশ্বর ঘুর্ণবায়ুতে এলিয়কে স্বর্গে তুলে নেওয়ার কথা বলেন, তখন যিরীহোর পঞ্চাশ জনশিষ্য-ভাববাদীগণ ঐ ঘটনা দেখার জন্য উপস্থিত হন। এলিয় ঘুর্ণ-বায়ুতে স্বর্গে চলে যাওয়ার সময় তাঁর শালখানি আশীর্বাদ স্বরুপ পড়ে রইল। ইলিশায় সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখিলেন এবং সেই পতিত শালখানি নিয়ে যর্দন নদীর কাছে আসলেন। আর তিনি শালখানি লইয়া জলে আঘাত করে বললেন, ‘ এলিয়ের ঈশ্বর কোথায়।’ ঠিক তখনই নদীর জল এদিক ওদিক বিভক্ত হইল আর ইলিশায় পার হইয়া আসলেন। এ সেই নদী, যে নদীতে যোহন বাপ্তাইজক মন পরিবর্তনের জন্য লোকদের জলে বাপ্তিস্ম দিতেন।
কুষ্ঠ নামানের যুগান্তকারী আত্মসাক্ষ্য ঃ- পরে তিনি (নামান) আপন সঙ্গী জনগণের সহিত ঈশ্বরের লোক ইলিশায়ের নিকট ফিরিয়া আসিলেন। আর তিনি দাঁড়াইয়া কহিলেন, দেখুন, “ আমি এখন জানিতে পারিলাম, সমস্ত পৃথিবীতে আর কোথাও ঈশ্বর নাই, কেবল ই¯্রায়েলের মধ্যে আছেন ”- ১৫ পদ। আজ আমাদের দেখে অবিশ্বাসীরা কি বলে যে, আমরা ঈশ্বরের লোক অথবা বলে, খ্রীষ্টানদের মধ্যে ঈশ্বর আছেন ? খ্রীষ্টানদের ঈশ্বর জীবন্ত, সত্যময় ঈশ্বর ?
উপসংহার ঃ- পবিত্র বাইবেল এই কথা বলে, ‘ কর্ম বিহীন বিশ্বাস মৃত।’ কুষ্ঠ নামান প্রবল বিশ্বাস নিয়ে ছুটে এসেছিলেন যেন তিনি কুষ্ঠ থেকে আরোগ্য লাভ করেন এবং আর অন্য সমস্ত লোকের মত তিনিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তাঁর প্রচন্ড বিশ্বাস ছিল ঠিকই কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি ঈশ্বরের লোকের বাক্যের বাধ্য না হইলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আরোগ্য হন নি। বিশ্বাস আর বাধ্যতা যখন একত্রে কাজ করল ঠিক তখনই নামান তাঁর এত দিনের সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান হইল। তাঁর জীবনে নূতন সূর্য্য উদিত হইল, তিনি কুষ্ঠ হইতে শুচি হইলেন এবং সাক্ষ্য দিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের নীরব থাকার কোন সুযোগ নাই, এই কথা মনে রেখে আমাদের খ্রীষ্টিয় জীবনে সাক্ষ্য বহন করা জরুরী যেন সমূদয় মর্ত ঈশ্বরের মহিমা দেখতে পায়, আমেন।
পাষ্টর কিশোর তালুকদার
হাউজ চার্চ অব বাংলাদেশ, ঢাকা।
১৬ই জুন ২০২০ খ্রীঃ