মুক্তিকামী মানুষের পরম আনন্দের দিন ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও

ads20
    সমগ্র বিশ্ব যখন অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন আর পাপাচারের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল—যখন সমগ্র গ্রেকো-রোমান সভ্যতায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে পশুর মতো জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখন নির্যাতিত, নিপীড়িত আর মুক্তিকামী মানুষের ত্রাতা হয়ে, আলোর দিশারি হয়ে মানবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিস্ট। শাসকগোষ্ঠী আর উত্পীড়নকারীর অত্যাচার, সামাজিক অন্যায্যতা, মানুষের পাপ আর অসত্যের অন্ধকারে নিমজ্জিতদের বিপরীতে যিশুখ্রিস্টের সত্যনিষ্ঠ মানবতার বাণী—সমাজে খেটে খাওয়া ক্রীতদাস, নিঃস্ব মজুর, কৃষক ও হতদরিদ্রদের নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিল।আর তাই তাঁর প্রচারিত খ্রিস্টধর্মের মর্মবাণী এই নির্যাতিত, নিপীড়িত জনসাধারণের কাছে যেমন ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল, তেমনি করে তাদের ওপর নেমে এসেছিল উত্পীড়ক শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতনের খড়্গ। কিন্তু বিশাল সূর্যের আলোকে যেমন বস্তুগত কোনো কিছু দিয়ে আটকে রাখা যায় না, তেমনি যিশুখ্রিস্টের এই সূর্যদীপ্ত মানবতার বাণী, তাঁর প্রচারিত ধর্মমত আর জীবনদর্শনকেও অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী অত্যাচারের খড়্গের মধ্য দিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এ জন্য সমগ্র বিশ্বের মানুষকে আলোর পথে, শান্তির পথে, মানবতার পথে পরিচালিত করার জন্য নির্মম নির্যাতন আপন দেহে ধারণ করে মাত্র ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ যিশুখ্রিস্ট শুরু করেছিলেন, তার ছায়াতলে আজ প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে এবং খ্রিস্টধর্ম বিশ্বের সর্ববৃহৎ একটি ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আলোর দিশারি ঈশ্বরপুত্র এই মহামানবের জন্মোৎসবকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন উৎসব পালন করে থাকে। 
    ২.
    পৃথিবীতে মহান ঈশ্বরের অসংখ্য রহস্যলীলার মধ্যে অন্যতম হলো যিশুখ্রিস্টের জন্মের ঘটনা। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী অত্যাচারী শাসক হেরোদ রাজার শাসনাধীন জেরুজালেমের বেথেলহেমে মাতা মেরির গর্ভে যিশুর জন্ম হয়। মাতা মেরি ছিলেন ইসরায়েলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। সৎ, ধর্মপ্রাণ ও সাধু এই মানুষটি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। একদিন স্বর্গদূতের কাছ থেকে মেরি জানতে পারেন, মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে তাঁর গর্ভে ঈশ্বরের পুত্র আসছেন।
    দূত শিশুটির নাম যিশু রাখার নির্দেশ দেন। স্বর্গদূতের এ কথা শুনে দারুণভাবে বিচলিত হন মেরি। তিনি তাঁকে বলেন,  ‘এটা কিভাবে সম্ভব! আমার তো বিয়ে হয়নি। ’ স্বর্গদূত মেরিকে বলেন, ‘পবিত্র আত্মা তাঁর ওপর অধিষ্ঠিত হবেন এবং তার প্রভাবেই মেরি গর্ভবতী হবেন এবং তাঁর ছেলে হবে। বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়, ‘পবিত্র আত্মা থেকে মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন। ’ [মথি, ১:২০]।  
    অন্যদিকে মেরির বাগদত্তা স্বামী যোসেফ যখন জানতে পারেন মেরি সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁকে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঈশ্বরের দূত তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, মেরি গর্ভবতী হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে এবং তাঁর যে সন্তান হবে তা ঈশ্বরের পরিকল্পনায়। যোসেফ যেন মেরিকে সন্দেহ না করে গ্রহণ করে। তখন যোসেফ দূতের কথামতো মেরিকে বিয়ে করেন। তবে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন। [মথি, ১:২৫]।
    মেরির সন্তান প্রসবের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, ঠিক সেই সময় রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার আদমশুমারি করেন। তিনি নির্দেশ দেন যার যার পিতৃপুরুষদের শহরে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। যোসেফের পিতৃপুরুষরা ছিলেন যিহুদিয়ার বেথেলহেমের। যোসেফ তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেরিকে নিয়ে নাম লেখাতে সেখানে গেলেন। কিন্তু নাম লেখাতে প্রচুর লোক আসায় তাঁরা থাকার জন্য কোনো জায়গা পেলেন না। পরে একজন লোক তাঁদের গোয়ালঘরে থাকতে দিলেন। সেখানেই মেরি সন্তান প্রসব করেন এবং কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে (যে পাত্রে পশুদের ঘাস, খড় বা পানি খেতে দেওয়া হয়) রাখলেন। স্বর্গদূতের কথামতো যোসেফ শিশুটির নাম রাখলেন যিশু। এভাবে এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্বজগতে দেহ ধারণ করলেন ঈশ্বরপুত্র যিশু।

    ৩.
    দুই হাজার বছর আগে যিশুর জন্ম হলেও বড়দিন পালন শুরু হয় অনেক পরে। এমনকি যিশুর শিষ্যরাও কখনো তাঁর জন্মোৎসব পালন করেননি বা তাঁর জন্মদিনকে ধর্মীয় উৎসবে রূপান্তর করেননি। শুধু তা-ই নয়, শুরুর দিকে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বড়দিন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। দ্বিতীয় শতাব্দীর দুজন খ্রিস্টধর্মের গুরু ও ইতিহাসবিদ ইরেনাউস ও তার্তুলিয়ান বড়দিনকে খ্রিস্টানদের উৎসবের তালিকায় যুক্ত করেন।
    ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিসরে প্রথম বড়দিন পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদ লুসিয়ান তাঁর সময়ে ক্রিসমাস পালিত হতো বলে উল্লেখ করেছেন। ২২১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের একটি দিনপঞ্জিতে লেখা হয়েছিল, মাতা মেরি ২৫ মার্চ গর্ভধারণ করেন। এ বিষয়টি রোমান ক্যালেন্ডারেও ছিল। সে হিসাবে গর্ভধারণের ৯ মাস পর ২৫ ডিসেম্বর যিশু জন্মগ্রহণ করেন বলে খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা মত দেন।জানা যায়, ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমে সর্বপ্রথম বড় আকারে বড়দিন উদ্‌যাপন শুরু হয় ‘স্যাটার্নালিয়া’ উৎসবকে কেন্দ্র করে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশেও। ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান পঞ্জিকায় ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন উল্লেখ করে দিনটিকে যিশুর জন্মদিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৪৪০ সালে পোপ একে স্বীকৃতি দেন।মধ্যযুগে বড়দিন উৎসব আরো জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ৮০০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর জার্মানির রাজা রোমান সম্রাট হিসেবে গির্জা কর্তৃক মুকুট ধারণ করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা সেন্ট স্টিফেন হাঙ্গেরিকে খ্রিস্টান রাজ্য ঘোষণা করেন। ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা উইলিয়াম ইংল্যান্ডের মুকুট ধারণ করেন। ক্রিসমাস উৎসব প্রসারে এগুলো বেশ প্রভাব ফেলে। তবে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের সময় একদল লোক বড়দিন পালনের বিরোধিতা শুরু করে। তাদের অভিযোগ, উৎসবটি পৌত্তলিক ও ধর্মীয়ভাবে এর কোনো তাৎপর্য নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের গোঁড়া শাসকরা ১৬৪৭ সালে বড়দিন উৎসব পালন নিষিদ্ধ করে। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এ নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। বর্তমানে শুধু ক্যাথলিক নয়,  প্রটেস্ট্যান্টসহ সব খ্রিস্টানই এ উৎসব পালন করেন। ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিসমাস উদ্যাপিত হয় ১৬৬৮ সালে। কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তনকারী জব চার্নক প্রথম বড়দিন পালন শুরু করেন বলে জানা যায়। সেই থেকেই আমাদের দেশে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে।বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালিত হলেও রাশিয়া, জর্জিয়া,  মিসর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ার মতো কিছু দেশের ন্যাশনাল চার্চে ৭ জানুয়ারি বড়দিন পালন করা হয়ে থাকে। কারণ এসব চার্চ ঐতিহ্যশালী জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে। আর জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৫ ডিসেম্বরের প্রামাণ্য জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারে ৭ জানুয়ারি তারিখ পড়ে।
    ৪.
    যিশুখ্রিস্টের জন্মোৎসব উপলক্ষে উদ্যাপিত এই বড়দিন—যে দিন, যে তারিখ বা যে মাসেই উদ্‌যাপন করা হোক না কেন, মুক্তিকামী মানুষের কাছে তা যে এক পরম পূজনীয় আনন্দের দিন, তা আর বলার অবকাশ রাখে না। কারণ এ দিনেই সমগ্র বিশ্বের মানবতাকামী মানুষ পাপ, অন্যায়, নির্যাতন, জুলুম,  নিপীড়ন আর অসত্যের অন্ধকার থেকে মুক্তির পথের সন্ধান পেয়েছিল। এ দিনই মুক্তিদাতা যিশুকে ঈশ্বর সমগ্র মানবজাতির জন্য উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। ঈশ্বর আপন পুত্র যিশুর মধ্য দিয়ে স্বর্গের সঙ্গে মর্তের মানুষের মিলন ঘটিয়েছেন। ঈশ্বর স্বর্গে বিরাজমান। কিন্তু আমরা যিশুর নির্দেশিত ধর্মপথে তাঁর জীবনদর্শন অবলম্বন করেই কেবল স্বর্গে আরোহণ করতে পারি। তাই যিশুর জন্মোৎসব উপলক্ষে উদ্যাপিত এই বড়দিন শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য এক পরম আনন্দের দিন।

    বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা যিশুর আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। অর্থাৎ সমাজ ও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই যে হানাহানি, জাতিতে জাতিতে লড়াই, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারে মানবতার বিপর্যয়—এর বিপরীতে সৌম্য, শান্তি আর ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে মানবতার জয় ঘোষণা করাই বড়দিনের মূল শিক্ষা। যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীতে এসেছেন শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই আমরা যখন বড়দিনের উৎসব পালন করি, তখন যেন পরস্পরের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির চেতনা লাভ করতে পারি। ঈশ্বর আমাদের কাছে যিশুখ্রিস্টকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। বড়দিনের মধ্য দিয়ে আমরা যেন একে অন্যের জীবনে উপহার হয়ে উঠতে পারি। একে অন্যের শান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারি। সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি—তবেই বড়দিনের আনন্দ সার্থক হবে।



    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS