ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের আদি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যেসব মানুষ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজে যে যে ধরনের পরিবর্তন এনেছেন, তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়ের নাম থাকবে সবার উপরে। এর কারণ হচ্ছে আঠারো এবং উনিশ শতকে বাংলার মাটিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা- এসব ক্ষেত্রে যে যে পরিবর্তন এসেছে তার জন্য পুরো কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের। তার সাথে আরও অনেকেই সে সময় কাজ করেছেন। কিন্তু শুরুটা করে দিয়েছিলেন তিনিই। আজকে আমরা বাংলায় যে সমাজ দেখি, শিক্ষার দিক দিয়ে যে পরিবর্তনের ধারা দেখি, তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তার অবদান আরও বেশি করে মনে রাখার মতো এবং গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সে সময় ইংরেজদের আধিপত্য ছিল বেশি। তাদের নির্দেশেই সকল কাজ হতো। এরকম সময়ে বাঙালি হয়ে নিজের মতাদর্শ প্রকাশ করা এবং প্রচার করা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ ছিল নিঃসন্দেহে।
ইংরেজদের আধিপত্যের মধ্যেও বাঙালি হয়ে নিজের মতাদর্শ প্রকাশ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়; Source: twitter.com
পলাশীর যুদ্ধের পনেরো বছর পরে বাংলার রাধানগরে ১৭৭২ সালের ২২ মে রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম। একটি সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কাজ করে ইচ্ছা করলে তিনি আভিজাত্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি বাংলার বাইরে বের হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন, সেসব দেশের সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছেন। নিজ দেশের বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য দেশের মানুষের সাথে নিজেকে যুক্ত করার জন্য ফার্সি, আরবি, হিব্রু ও গ্রিক ভাষা শিখেছেন। নিজের দেশের সাহিত্যের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি এবং তাদের সৃষ্ট সাহিত্য আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর পূর্ব দিকে অবস্থিত অন্যান্য দেশের সাহিত্যকর্ম নিয়েও তার অগাধ জ্ঞান ছিল। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার পড়াশোনা থাকার কারণে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলার বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে সমালোচনা করতে পেরেছেন এবং সেখানকার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন।
রামমোহন রায় অবিরামভাবে সারা জীবন সামাজিক কিছু রীতিনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে জাত বা সমাজের স্তরবিন্যাস ও জাতি বিদ্বেষ এবং আরেকটি সতীদাহ প্রথা। তার সময়ে এই দুই রীতির প্রভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং চেতনাবোধের অভাব দেখা দেয়। শক্ত হাতে তিনি তা দমন করেন।
তিনি আভিজাত্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন; Source: blueplaqueguy.byethos24.com
রাজা রামমোহন রায় নিজেকে শুধু শিক্ষিত করে তোলেননি, বরং সমাজের অন্যান্য মানুষও যেন সঠিক শিক্ষার আলো পায় সেজন্য তিনি আধুনিক বাংলা ভাষায় সংস্কৃত উপনিষদগুলোকে অনুবাদ করেছিলেন। এই কাজটি তিনি করেছিলেন সমাজের মানুষদের কুসংস্কার এবং সামাজিক কিছু নিষ্ঠুর রীতিনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য। তখন সমাজের একটু নিম্ন শ্রেণির মানুষদের খুব সহজেই শিক্ষিত কেউ উপনিষদের কথা বলে প্রভাবিত করতে পারতো। যেহেতু এগুলো সংস্কৃতে লেখা ছিল, তাই অনেকেই তা পড়তে পারতো না। যাতে সবাই নিজেদের পরিচিত ভাষায় পড়াশোনা করতে পারে, সেজন্য তিনি এই কাজটি করেছিলেন। সমাজ সংস্কারে তার চেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বাইরের দেশে ভ্রমণ এবং সেখানে যা কাজ হচ্ছে, সেগুলোর সাথে বাংলার মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। তিনি জানতেন যে, শিক্ষা ছাড়া এই দেশের মানুষ কখনও উন্নতি করতে পারবে না। আবার উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তাদের মতো করে ভাবতে হবে, তাদের কাজগুলো বুঝতে হবে, তাদের সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাজা রামমোহন রায়ের পশ্চিমা দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এবং তাদের সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া জ্ঞান নিয়ে আমূল আগ্রহ ছিল।
ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের মূর্তি; Source: probashionline.com
তার সময়ে বিজ্ঞানে চলছিল নিউটন পরবর্তী যুগ এবং শিল্প-কারখানা সৃষ্টির একটি রেনেসাঁ যুগ। তখন পশ্চিমারা নিজেদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত করার চেষ্টা করছে। রাজা রামমোহন রায়ের মনে হয়েছিল, পশ্চিমে বিশেষ করে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানে যা হচ্ছে, তা কখনোই ফেলে দেয়ার মতো না এবং এসবকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। এজন্য তিনি দেশে ফিরে নিজেদের পড়াশোনার মধ্যে ইংরেজি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেন এবং সমাজের মানুষদেরকে বোঝান যে নিজেদের দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে হলে অবশ্যই সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাটাও রপ্ত করতে হবে। সে সময়ের চিত্র যদি আমরা এখন পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইউরোপের মধ্যে সেসময় কী পরিমাণ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিলো, যেটা তখন রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছিলেন।
শিক্ষা ছাড়া বাংলার মানুষ উন্নতি করতে পারবে না, এটা রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছিলেন; Source: youtube.com
নিউটনের সময়ে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি সাধন হয়, সেটার পেছনে সেই দেশের অভিজাত শ্রেণির মানুষদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। রয়্যাল সোসাইটি এবং এর মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে প্রচার করেছিলো এবং বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলো। অন্যদিকে বাংলার মাটিতে এমন কাজ করার কেউ ছিল না। ইংরেজদেরও একধরনের অনিচ্ছা ছিল এই দেশের মানুষদের উন্নত করার প্রতি। এখানকার মানুষদের খাটিয়ে নিয়ে তারা নিজেদের দেশের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি করছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ক্রমেই যে দুই দেশের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, রামমোহন রায় তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই যখন ইংরেজরা কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ তৈরি করার কথা বলে, তখন তিনি প্রচণ্ডভাবে সেটার বিরোধিতা করেন। সেখানে তিনি প্রস্তাব করেন শুধু সংস্কৃতি নয়, সেখানে বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল এসব বিষয়ও পড়াতে হবে। তার ধারণা ছিল পশ্চিমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং তাদের নিত্য-নতুন আবিষ্কার এবং ধারণাগুলোকে বুঝতে হলে উপমহাদেশ তথা বাংলার ছেলেমেয়েদেরকেও এসব বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান দিতে হবে, যাতে তারা নিজ দেশকে উন্নত করতে পারে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর সাথে যেন প্রতিযোগিতা করতে পারে। তার এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ধারণা আমাদের দেশের সমাজে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছিলো।
সতীদাহ প্রথা খুব কড়াভাবে রোধ করেন তিনি; Source: tamilandvedas.com
অনেকেই মনে করেন, রাজা রামমোহন রায় পশ্চিমাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করতেন, কিন্তু আদৌ ব্যাপারটি এরকম ছিল না। তিনি বিভিন্ন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায় যখন খ্রিস্টান সম্প্রদায় কর্তৃক সমালোচিত হতো, তখন কড়া ভাষায় সেগুলোর প্রতিবাদ করতেন। ঠিকভাবে প্রতিবাদ করার জন্যই তিনি গ্রিক এবং হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলার মানুষদের স্বাধীন চিন্তাধারার পক্ষে ছিলেন। সেজন্য ব্রাহ্ম সমাজ নামক একটি ধর্মীয় সংঘও গড়ে তোলেন, যেখানে স্বাধীন চিন্তাধারার বিষয়ে আলোচনা করা হতো এবং তাদের বিশ্বাস সমাজে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হতো। এমনকি তিনি যখন দিল্লির সম্রাটের পক্ষ থেকে ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিতে যান, তখন তার কথা এবং আলোচনার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ দেশ, তা পুরোপুরি প্রকাশ পায়। ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে বাংলার এই মহান পণ্ডিত এবং সমাজ-সংস্কারক ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন।রাজা রামমোহন রায়ের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং প্রযুক্তিতে যেন কোনো পার্থক্য না থাকে, এই দেশের মানুষ যেন কোনোভাবে পিছিয়ে না থাকে। তিনি যদি এখন কোনোভাবে দেখতে পারতেন যে দু’শ বছর আগে তার দেখিয়ে দেয়া পরিবর্তনগুলো এখন সমাজে পরিবর্তন এনেছে এবং আধুনিক সমাজ গড়ে তুলেছে, তাহলে হয়তো তিনি খুশি হতেন; কিন্তু আধুনিক সমাজে যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষ এবং শিক্ষিত মানুষের মাঝেও যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বা ঘটছে, সেগুলো দেখে হয়তো মন খারাপও করতেন।
তথ্যসূত্র [১] Jayant Narlikar (2003) The Scientific Edge, Penguin Books
[২] রাজর্ষি রামমোহন- জীবনী ও রচনা – অনিলচন্দ্র ঘোষ
ফিচার ইমেজ সোর্স: Great Indian Freedom Fighters