ক্রুশে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন :
ত্রুশে টাঙ্গিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ইতিহাস বহু পুরানো ।Britannica reports থেকে জানা যায় যে ৫১৯ স্বষ্ট পূর্ধাব্দে এতিহাসিকভাবে প্রথমবার পারস্যের রাজা ডারিয়াস ১ ব্যাবিলনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে ৩০০০ লোককে ক্রুশে মৃত্যুদণ্ড দেন। (Encyclopaedia Britannica, crucifixion) পরবর্তীতে গ্রীসে এটি প্রচলিত হয়। আলেকজেপ্তার দি গ্রেটও এই প্রথায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। নিষ্ঠুরতা ছিল প্রাচীন যুগের শাসনের বৈশিষ্ট্য, আর ক্রুশীয় মৃত্যু ছিল সে যুগের অন্যতম নিষ্ঠুর প্রাণদণ্ড। ফোনেশীয়া ও পারস্য দেশে এই প্রাণদণ্ডের প্রচলন করা হয় এবং পরবর্তিতে রোমীয় শাসকগণ এই নিষ্ঠুর প্রাণদণ্ড প্রথাটি বহাল রাখে । সেই সময় ক্রুশ কথাটি শুনলেই লোকের মন ঘৃণা আর বিতৃষ্ঠায় ভরে উঠত ও ভয়ে সবাই শিউরে উঠত। তাই ক্রুশকে সবাই ঘৃণা করত। অপমান আর জঘন্য ঘৃণার প্রতীক ছিল ক্রুশ। এই ক্রুশীয় মৃত্যুদণ্ড নিরূপিত ছিল জঘন্য ক্রীতদাসদের, যারা মারাত্মক অপরাধী, ব্যাভিচারী, রাষ্ট্রদ্রোহী, ডাকাত, গুপ্তচর তাদের জন্য । তাদের অপমান যেন চরম থেকে চরমতর হয় সে জন্য তাদের রোমীয় রীতিতে উলঙ্গ করে ক্রুশে দেওয়া হতো । পুরাতন নিয়মে সরাসরি ত্রুশে দেওয়ার প্রচলন না থাকলেও অপরাধীকে প্রথমে পাথর ছড়ত, আর যখন সে মৃতপ্রায় তখন তার যন্ত্রণা ও অপমান যেন আরও প্রকট হয় সেজন্য তাকে গাছে টাঙ্গিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত।
“যদি কোন মনুষ্য প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাপ করে, আর তাহার প্রাণদণ্ড হয় এবং তুমি তাহাকে গাছে টাঙ্গাইয়া দাও, তবে তাহার শব রাত্রিতে গাছের উপরে থাকিতে দিবে না, কিন্তু নিশ্চয় সেই দিনই তাহাকে কবর দিবে; কেননা যে ব্যক্তিকে টাঙ্গান যায়, সে ঈশ্বরের শাপত্রস্ত;... (দ্বিতীয় বিবরণ ২০ : ২২-২৩)। অপরাধীকে নিজের ক্রুশের একটি অংশ, যে অংশটি আড়া-আড়ি থাকে সেটি তাকেই বহন করতে বাধ্য করা হতো । প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত কাঠের সাথে আটকানো হত। শরীরের ভারে হাত যেন ছিড়ে না যায় সে জন্য পায়ের কাছে কিছুটা কাঠ উচু রাখা হতো। আপরাধীর অপরাধ এবং তার নাম একটি ফটকে লিখে অপরাধীর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। যীশুকেও দেওয়া হলো কিন্তু তা গলায় নয় কিন্তু মাথার উপরে কাঠের সাথে। আর অপরাধের লিস্টে যা লেখা ছিল, তা হলো “ইনি যিহূদীদের রাজা” সংক্ষেপে [INRI]। লোকেরা প্রতিবাদ জানালে পিলাত বলেছিল, “আগ্বাফে, আগ্রাফে (প্রীক), যা লিখিয়াছি, তাহা লিখিয়াছি।”
অনেক সময় ৪/৫ দিনেও অপরাধীর মৃত্যু হতো না। ক্রুশের উপর সাধারণত যে যাতনা হতো সেগুলো হলো, অসহ্য ক্ষুধা এবং তৃষ্তা, তীব্র জালা, মাথা ব্যথা, পেশির যন্ত্রণা শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। আর এই শ্বাস বেড়ে যাওয়াতেই তার কষ্ট আরও বহুগুণে বেড়ে যেতো । আর একটি মর্মান্তিক কষ্ট হতো তা হলো, অপরাধীর এই কষ্ট দেখে কেউ সমবেদনা তো জানাতোই না, বরং তাদের অপরাধের লিস্ট দেখে বলত, ভালই হয়েছে, তুমি এখন মরো । এ দণ্ড যে কী পৈশাচিক ও বীভৎস তা বর্ণনা করার ভাষা কারও নেই। পরবর্তীতে রোমীয় সম্রাট কনস্টানটাইন এই নিষ্ঠুর মৃত্যুদণ্ড রহিত করেন।
অপূর্ব ক্রুশের মহিমা :
খ্রীষ্টের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ক্রুশ শব্দের কোন আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ছিল না। কিন্ত প্রভু যীশু খ্রীষ্ট এই ঘৃণিত ক্রুশকে করলেন মহিমান্বিত যে ক্রুশের কথা শুনে একদিন মানুষ আতকে উঠত, আজ সেই ক্রুশ মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বস্তু । মানুষ সযত্রে তা গলায় পরে আর বিশ্বাস করে যে শ্রীষ্ট আমার সঙ্গে আছেন। যে রোমীয় সম্রাট একদিন খ্বীষ্টকে জঘন্য ত্রুশীয় দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন, সেই রোমীয় শাসন কর্তারাই আবার একদিন ক্রুশ চিহৃকে জাতীয় পতাকায় শোভিত করেছিলেন । আজও দেখা যায় অনেক দেশের জাতীয় পতাকায় ক্রুশ চিহ্তে সুশোভিত । কত শ্রীষ্টিয়ান লেখক ক্রুশের জয়গান লিখেছেন, “অপূর্ব এ ক্রুশ, ক্রুশের কাছে রাখ হে, ক্রুশ যাহার সুপরিচয়, ইত্যাদি। কত গীর্জাঘর তৈরী হচ্ছে ক্রুশের আকারে । আজ আমরা মৃত জনের সমাধি দিচ্ছি ক্রুশ চিহ্কের নিচে। আজ বিশ্বের সমস্ত লোক জানে ক্রুশের মহিমা। রেড ক্রস বা লাল ক্রুশ হলো সেবা আর পরিচর্যার এক মহান প্রতিলিপি। তাই আজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা জানায় এই লাল ক্রুশকে ।
সংক্ষিপ্তভাবে ক্রুশ হলো স্বীষ্টের সুসমাচার :
সুসমাচার প্রচার হলো ক্রুশারোপিত শ্রীষ্টের কথার বা বাক্যের প্রচার। সেই জন্য প্রেরিতগণ প্র বীশু খ্রী্টের ক্রুশ সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করতেন এবং খ্রীষ্টের ক্রুশের জন্য অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করাকে আনন্দজনক মনে করতেন। তাই স্পষ্টত দেখা যায়, ক্রুশ সুসমাচারের মমার্থ। প্রেরিতগণ এই ক্রুশের কথা প্রচার করেছেন এবং আমাদেরও এই ক্রুশের কথাই প্রচার করতে হবে।
ক্রুশ হলো মহা মিলনের বার্তা :
যখন কেউ খ্রীষ্টের ক্রুশের দিকে তাকা এবং তীর প্রেমের কথা স্মরণ করে, তখন কেউই পরস্পরের সাথে এবং ঈশ্বরের সাথে শত্রুতা রাখতে পারে না। ক্রুশ হলো সেতু বন্ধন, রাখি বন্ধন।
ক্রুশ হলো অকৃত্রিম ভালবাসার প্রতীক ঃ
খ্রীষ্টধর্মে কুশ স্রীষ্টিয়ানদের স্মরণ করিয়ে দেয় ঈশ্বরের ভালোবাসা, যার জন্য তার পুত্র কালভেরীতে সমখ মানুষের পাপভার নিজ স্কন্ধে তুলে নিলেন এবং সকলের পক্ষে একা মৃত্যুবরণ করলেন। সুতরাং ক্রুশ হলো অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক।
“একদা এক দিনের শেষে পথের পাশে একটি ক্রুশের মুখোমুখি হলাম, আমি এবং আমার বুকের মধ্যে আত্মা আছে- তারই কাছে বলল যেন, প্রতীকী এ ক্রুশটি তার আপন কথা স্পষ্ট করে, আত্মা, তুমি দেখছ আমার চারটি বাহু চারিদিকে সে প্রসারিত চারটি পূর্ণ শাখার মতো, অন্তবিহীন অসীমতার দিকে তার প্রবর্তনা চার রকমে নির্দেশিত, চারটি পথ দেখিয়ে দিচ্ছে জীবন জয়ের পূর্ণতাকে, অনস্তেরই অভিমুখে :
১। একটি শাখা উর্দ্ধমুখী অস্তবিহীন অসীমতার দিকে,
দেখিয়ে দিচ্ছে স্বর্গীয় সেই ভালোবাসার অবাক উচ্চতাকে
২ ও ৩। ডানে বামে দুটি বাহু দেখিয়ে দিচ্ছে অনন্ত বিস্তৃতি,
বলছে যেন দৃপ্ত ঘোষণায়
স্বীয় প্রেম- নেই যে তার সীমা পরিসীমা,
সে যে অশেষ, অন্তবিহীন আলোক অভিসার ।
৪ । আর এক বাহু নিম্নমুখী অনন্ত এ ভূমিতলে
অতলতার দিকে প্রবর্তিত,
দেখাচ্ছে সে ঈশ্বরের ভালোবাসা মাটির নিচে অন্ধকারের অন্তরালে,
সেখানেও দীন্ত বহমান
সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তে ভালোবাসার জয় ”
(মুল : ফ্রেডেরিক জর্জ স্কট)