পবিত্র বাইবেলের দৃষ্টিকোন থেকে আমরা দেখতে পাই যে, যীশু খ্রীষ্ট তিনি নিজের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দাবি করেছেন। এর মধ্যে তিনি বলেচেন, “ আমিই উত্তম মেষপালক।” যদিও পূরাতন নিয়মে কয়েক জন মেষপালকের কথা দেখতে পাই। কিন্তু তারা কেউই নিজেকে উত্তম মেষপালক হিসাবে দাবি করেন নি। কারণ তারা সকলেই এই পৃথিবীর সাধারণ নিয়মে জম্ম গ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষ হিসাবে সকলেই পাপী ছিলেন। তাই একমাত্র প্রভু যীশুই নিজেকে উত্তম মেষপালক বলতে পেরেছিলেন, আর কেউ নয়। এটি তাঁর অধিকার ছিল। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘ উত্তম মেষপালক, মেষদের জন্য আপন প্রাণ সমর্পণ করে।’ কিন্ত তার পরেও আর একজন মেষপালক ছিলেন, যিনি মেষদের জন্য নিজেন জীবন বিস্বর্জন দিয়েছিলেন, তিনি মোশি। এই জন্যই মোশি সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন ‘খ্রীষ্টের প্রতিচ্ছবি।’
১ম বিষয় ঃ- মেষপালক মোশি- আপন শ্বশুর যিথ্রো নামক মিদিয়নীয় যাজকের মেষপাল চরান- যাত্রা ৩;১।২ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই, মোশি ছোট কাল থেকেই রাজ পরিবারে বড় হযেছেন। রাজকীয় পরিবার মানেই অনেক কিছু শেখা, অর্জন করা। অনেক জ্ঞান এবং বুদ্ধি তার ছিল। একই সাথে সুযোগ্য নেত্তৃত্বের যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন। এক কথায় তিনি যে ভবিষ্যতে একটি জাতিকে পরিচালনা করবেন, এই লক্ষেই ঈশ্বর তাকে রাজ পরিবারেই লালিত-পালিত হওয়ার জন্য আশ্চর্য ভাবে পাঠিয়েছিলেন। এদিকে এক দিন কোন এক ঘটনার জন্য মোশি যখন মিসর থেকে পালিয়ে গিয়ে মিদিয়ন দেশের এক কুপের নিকটে বসেন, তখন কয়েকটি কন্যা আসিয়া তাদের পিতার মেষপালকে জল পান করাইতে আসে। তখন অন্য মেষপালকেরা তাদের তাড়াইয়া দিলে মোশি উঠিয়া তাহাদের সাহায্য করেন। ইহাতে ঐ কন্যাগণ ঐ দিন মোশির কারণে শীঘ্র বাড়িতে পৌঁছেছিল। যার কারণে তাদের পিতা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে মোশিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে আশ্রয় দেন। সেই থেকে মোশি তাঁর শ্বশুরের মেষপাল চড়াইতেন- যাত্রা ২;১৫-২২ পদ।
মোশির আহ্বান/দর্শন ঃ- একদা তিনি প্রান্তরের পশ্চাৎ ভাগে মেষপাল লইয়া গিয়া হোরেবে, ঈশ্বরের পর্বতে উপস্থিত হন। আর ঝোপের মধ্য হইতে অগ্নিশিখাতে সদাপ্রভুর দূত তাহাকে দর্শন দিলেন, ------------- যাইতেছেন, তখন ঝোপের মধ্য হইতে ঈশ্বর তাঁহাকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘ মোশি, মোশি ’। তিনি উত্তরে কহিলেন, দেখুন, এই আমি। তখন সদাপ্রভু কহিলেন, --- উহা পবিত্র। তিনি আরও কহিলেন, আমি তোমার পিতার ঈশ্বর, অব্রাহামের ঈশ্বর, ইসহাকের ঈশ্বর, যাকোবের ঈশ্বর। পরে সদাপ্রভু কহিলেন, ----------, সেই দুগ্ধমধুপ্রবাহী দেশে তাহাদিগকে আনিবার জন্য নামিয়া আসিয়াছি। অতএব এখন আইস, আমি তোমাকে ফরৌণের নিকটে প্রেরণ করি, তুমি মিসর হইতে আমার প্রজা ই¯্রায়েল সন্তানদিগকে বাহির করিও। তিনি কহিলেন, নিশ্চয় আমি তোমার সহবর্তী হইব, ------বাহির করিয়া আনিলে পর তোমরা এই পর্বতে আমার সেবা করিবে- যাত্রা ৩;১-১২ পদ।
উত্তম মেষপালক, মেষদের জন্য আপন প্রাণ সমর্পণ করেন = মোশি যে একজন উত্তম মেষপালক ছিলেন, তার প্রমাণ, ই¯্রায়েল জাতি যখন ঈশ্বরকে ভুলে গিয়ে ছাঁচে ঢালা গোবৎস নির্মাণ করে তাহার নিকটে প্রণিপাত করছিল, তখন ঈশ্বর এই জাতিকে বিনষ্ট করিতে মনস্থ করিলে মোশি সেই জাতির জন্য ঈশ্বরের নিকটে সাধ্যসাধনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ আহা! এখন ইহাদের পাপ ক্ষমা কর- আর যদি না কর, তবে আমি বিনয় করিতেছি, তোমার লিখিত পুস্তক হইতে আমার নাম কাটিয়া ফেল- যাত্রা ৩২;৩২ পদ। মেষদের জন্য কেমন চিন্তা, কেমন আবেদন/বিনতী প্রার্থনা ? তাহা কেবল একজন উত্তম মেষপালকের পক্ষেই সম্ভব। যিনি নিজের স্বার্থের চেষ্টা করেন না। কিন্তু বর্তমানে এমন অনেক মেষপালক আছেন, শুধু নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। প্রথম চল্লিশ বছর ধরে মোশিকে প্রস্তুতির জন্য রাজ প্রাসাদে জীবন কাটাতে হয়েছিল। পরের চল্লিশ বছর তিনি মরু প্রান্তরে কাটিয়েছিলেন। এই সময় তার জন্য বাস্তব প্রস্তুতির সময়কাল ছিল। পরবর্তীতে চল্লিশ বছর ই¯্রায়েল জাতিকে ঈশ্বরের উদ্দেশে এক জন সুযোগ্য নেতা হিসাবে নেত্তৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন ঃ- বর্তমানে যারা মেষপালক/পালক, প্রকৃত পক্ষে তাদের জীবনে কি ঈশ্বরের আহ্বান আছে ? মেষদের জন্য কতটা চিন্তিত ? নাকি স্বার্থপর মেষপালক ?এই জন্যই পবিত্র বাইবেল ‘ দুষ্ট ও উত্তম ’ মেষপালকদের বিষয়ে কঠিন কথা বলেছে। বিশেষত: যারা দুষ্ট পালক, নিজেদের পালন করছে- যিহিস্কেল ৩৪ অধ্যায়।
২য় বিষয় ঃ- আমিই উত্তম মেষপালক; উত্তম মেষপালক মেষদের জন্য আপন প্রাণ সমর্পণ করে- যোহন ১০;১১ পদ।
যখন যীশু দুই জন অন্ধকে সুস্থ করলেন এবং দৃঢ়রুপে নিষেধ করে দিলেন যে, যেন কেহ এই বিষয়ে জানতে না পারে। কিন্তু তাহারা বাহিরে গিয়া দেশময় প্রভুর সেই মহিমার কথা প্রকাশ করল। ঠিক এর পরেই তিনি এক জন ভূতগ্রস্থ গোঁগাকে সুস্থ করলেন, তাহা দেখিয়া সমূদয় লোক আশ্চর্য্য জ্ঞান করল এবং স্বাক্ষ্য দিল যে, ই¯্রায়েলের মধ্যে এমন কখনও দেখা যায় নাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঐ সময়ে ফরীশীগণ তাহা দেখিয়া সন্তোষ্ট হয় নাই। এর পরেই তিনি বিস্তর লোক দেখিয়া করুণাবিষ্ট হইলেন, কেননা তাহারা ব্যাকুল ও ছিন্নভিন্ন ছিল, যেন পালকবিহীন মেষপাল। অর্থাৎ যে সব লোক বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য হয়েছিল, মূলতঃ তাদেরকে পরিচালনা দেওয়ার মত নির্দিষ্ট কোন নেতা/পালক ছিল না। এই কারণেই প্রভু তাদের দেখে করুণাবিষ্ট হইলেন।
শিষ্যদের মধ্যে কে মহান/শ্রেষ্ঠ এ নিয়ে দ্বিধা-দন্দ ছিল। এ বিষয়ে তিনি শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে কেহ মহান হইতে চায়, সে সকলের পরিচারক ও দাস হইবে। এর পর তিনি তাদের উপযুক্ত বা আদর্শ নেতার উদাহরণ স্বরুপ নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করলেন, বললেন, মনুষ্য পুত্র পরিচর্যা পাইতে আইসেন নাই, কিন্তু পরিচর্যা করিতে, এবং অনেকের পরিবর্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্য রুপে দিতে আসিয়াছেন (মথি ২০;২০-২৮)। সেই যীশু আমাদের অপরাধের নিমিত্ত সমর্পিত হইলেন ( ক্রুশের উপর জীবন দিলেন) এবং আমাদের ধার্মিক গণনার নিমিত্ত উত্থাপিত ( মৃত্যু থেকে জীবিত) হইলেন = রোমীয় ৪;২৫ পদ। ইনি (যীশু) আমাদের নিমিত্তে আপনাকে প্রদান করিলেন, যেন মূল্য দিয়া আমাদিগকে সমস্ত অধর্ম হইতে মুক্ত করেন, এবং আপনার নিমিত্ত নিজস্ব প্রজাবর্গকে, সৎক্রিয়াতে উদ্যোগী প্রজাবর্গকে, শুচি করেন = তীত ২;১৪ পদ।
৩য় বিষয় ঃ- পিতরের প্রতি প্রভু যীশু খ্রীষ্টের আদেশ = মেশির মতই যে রাজকীয় পরিবেশে শিষ্যরা বৃদ্ধি পেয়েছে তা ঠিক নয়। কিন্তু তার চেয়েও যিনি রাজাদের রাজা, সেই প্রভু যীশুর সঙ্গে থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতায় শিষ্যরা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই যীশু খ্রীষ্ট স্বর্গে চলে যাবার পূর্বে পিতরকে দৃঢ়রুপে আদেশ করলেন যেন পিতর তার মেষদের লালন-পালন করতে পারে। এই পিতরই মন্ডলীর জন্য নিজের জীবন দিয়েছিল। যীশকে যেভাবে ক্রুশে দেওয়া হয়, ঠিক তার উল্টো ভাবে পিতরকে ক্রুশে দিয়ে মারা হয়। যীশুর শিষ্যগণ সকলেই কোন না কোন ভাবে নির্যাতিত হয়ে প্রাণ দিয়েছেন। এই জগতে কোন শিষ্যই অর্থের পাহাড় অথবা প্রভাব প্রতিপত্তি রেখে যান নি। বরং খ্রীষ্টের জন্য সকলেই স্বাক্ষ্যমর হয়েছেন। পালের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। যা আমাদের প্রতিদিনের আত্মিক খোরাক যুগিয়ে থাকে।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের খ্রীষ্টিয় সমাজে অনেক মেষপালক আছে, স্বাক্ষ্যমর হওয়া তো দুরের কথা, তাদের নিয়ে সমাজে আছে সমালোচনার পাহাড়। মন্ডলীর সাধারণ বিশ্বাসীরা পুলপিট থেকে শুনে ঈশ্বরের বাক্য। আর বাস্তবে দেখে ভিন্ন চিত্র। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মেষপালকগণ অতি সাধারণ সহজ সরল বিশ্বাসীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের নামে গোড়ে তোলেন অর্থে পাহাড়, বাড়ী-গাড়ী। যার জন্য ঐ সাধারণ বিশ্বাসীরাও তাদের বিরুদ্ধে গোড়ে তোলেন সমালোচনার পাহাড়। এই ধরণের পালকদেরকেই বলা হয়েছে “ দুষ্ট মেষপালক ”। আবার এই দুষ্ট মেষপালকরাই মন্ডলী বিস্তারের নামে করছে প্রতিযোগীতা। এমন অবস্থায় মন্ডলীর সাধারণ বিশ্বসীরাও পরে যায় বিপাকে/বিভ্রান্তিতে। যার জন্য ঐ এক শ্রেণীর মেষপাল, তারা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় জীবন-যাপন করে। তারা কোন মন্ডলীর স্থায়ী সদস্য হতে পারে না। আবার মন্ডলীর সদস্য হয়ে লাভ কি ? সম্পাদক তো চোর, সে সব আত্মসাৎ করে বসে আছে। হিসাব চাইলে বলে, খরচ হইয়া গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপসংহার ঃ- তোমাদের মধ্যে ঈশ্বরের যে পাল আছে, তাহা পালন কর; অধ্যক্ষের কার্য কর, আবশ্যকতা প্রযুক্ত নয়, কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক, ঈশ্বরের অভিমতে, কুৎসিত লাভার্থে নয়, কিন্তু উৎসুক ভাবে কর; নিরুপিত অধিকারের উপরে কর্তৃত্বকারীরুপে নয়, কিন্তু পালের আদর্শ হইয়াই কর- ১পিতর ৫;২,৩ পদ। ঈশ্বরের এই জীবন্ত বাক্যের প্রতি বাধ্য থেকে আমাদের সমাজের বর্তমান মেষপালকদের জীবন-যাপন একান্ত জরুরী। যদিও পবিত্র বাইবেল এই কথা বলে যে, “ শিশুগণ, শেষকাল উপস্থিত, আর তোমরা যেমন শুনিয়াছ যে, খ্রীষ্টারি আসিতেছে, তেমনি এখনই অনেক খ্রীষ্টারি হইয়াছে; ইহাতে আমরা জানি যে, শেষকাল উপস্থিত- ১যোহন ২;১৮ পদ। এই সব কারণে মেষপালকদের/লিডারদের উপর সাধারণ বিশ্বাসীদের বিশ্বাস, আস্থা, নির্ভরতা, ভক্তিশ্রেদ্ধা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কারণ তারা নিজেদের লালন-পালন করছে (যিহিস্কেল ৩৪;২) পালের মেষদের নয়। কিন্তু সাধুবাদ জানাই সেই সকল পালকদের, যারা সত্যিকার ভাবে তার মেষদের জন্য চিন্তা করেন ও সেই মত তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। ঈশ্বর তাঁর জীবন্ত বাক্যের আলোকে আমাদের সকলকে আশীর্বাদ দান করুন,আমেন।
পালক কিশোর তালুকদার
হাউজ চার্চ অব বাংলাদেশ, ঢাকা।
মোবাইল:- ০১৭২৬১৭৬৪৭৭