যিশুখ্রিস্টের জন্ম মহাবিশ্বের একক ও অনন্য ঘটনা

ads20
    সৃষ্টির আদি থেকেই জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় চলছে। এখানে সৃষ্ট  জগতের সবকিছুরই শুরু ও শেষ আছে। এ জন্যই কবি বলেছেন: “জন্মিলে মরিতে হবে; অমর কে কোথা কবে?” সৃষ্ট জগতের এই ধারাবাহিকতা নিয়মের অধীন, জন্ম ও মৃত্যুর অধীন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তো সৃষ্টির অংশ নন, তাই তিনি এই ধারা বা নিয়মের বহির্ভূত। তার শুরু নেই, আবার শেষও নেই। তিনি অনাদি ও অনন্ত। যা ঐশ্বরিক বা দৈব, তা তো সৃষ্ট সমস্ত  কিছুর ঊর্ধ্বে, তাকে মানুষের ভাষায় প্রকাশ দুঃসাধ্য।
    অনাদি অসীম কালাতীত অরূপ অনন্ত বিমূর্ত ঈশ্বরের ধরাধামে সসীমতায় মানবরূপে দৃশ্যমান দেহগ্রহণ ও আবির্ভাব তাই একক ও অনন্য ঘটনা। ঈশ্বর সত্যস্বরূপ। তিনি  চৈতন্যস্বরূপ। তিনি আনন্দ। তিনি সচ্চিদানন্দ। যিনি বিশ্বাতীত তাকে ধরাধামে চক্ষুগ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে দেখার ক্ষমতা মানুষের নেই। সুতরাং যিশুখ্রিস্ট প্রচলিত অর্থে অবতার নন। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী  তিনি আসলেই রক্তমাংসের মানুষ হয়েছেন, শুধু মানুষের রূপ ধারণ করে ধরাধামে অবতীর্ণ হননি। সাধু যোহন তাই বলেন : বাণী হলেন দেহ। তিনি  বাণী কেন না তিনি নিজেই মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বপ্রভুর অরূপ বাণী দেহধারণ করে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অন্যথায় মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতো না। তাই সাধু যোহন বলেন:“বাণী  একদিন হলেন রক্তমাংসের মানুষ; বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তার মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম, একমাত্র পুত্র হিসাবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সেই যে-মহিমা, ঐশ অনুগ্রহ ও সত্যের সেই যে-পূর্ণতা” যোহন ১:১৪)। আমাদের মাঝে  মানুষের বোধগম্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ ব্যবহার করেই অরূপকে মানুষের কাছে প্রকাশ করার চেষ্টা। কিন্তু ভগবান বা ঈশ্বর তো অদৃশ্য নন, তিনি আমাদের কাছ থেকে তো দূরে নন: “কারণ তারই আশ্রয়ে আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের চলাফেরা, আমাদের অস্তিত্ব পেতে থাকা। . . . ‘আমরা তো তারই সন্তান।’” (শিষ্যচরিত ১৭:২৮-২৯)। 

    স্রষ্টাকে প্রত্যক্ষ করার উপায়
    অরূপকে রূপদান, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা, অসীম-অনন্তকে সসীমতায়, রূপ-রস-স্বাদহীন-গন্ধহীনকে আস্বাদনযোগ্য রসময় করার চেষ্টা মানুষের চিরকাল ধরেই। মঙ্গলবাণীর ভাষা হচ্ছে প্রেমের ভাষা। সেই ভালোবাসাকে পাশ কাটিয়ে ভালোবাসার সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। যে ভাষায় তিনি বর্ণিত সেই ভাষা হচ্ছে ভালোবাসার ভাষা। এই জন্যে সাধু যোহন সরাসরি বলেন: “যে ভালোবাসে না, সে তো এখনও মৃত্যুর মধ্যেই পড়ে আছে। যে-কেউ নিজের ভাইকে ঘৃণা করে, সে একটা খুনি; আর তোমরা জান যে, শাশ্বত জীবন কোন খুনির অন্তরে থাকতেই পারে না। ভালোবাসা যে কী, তা আমরা এতেই বুঝতে পেরেছি: যীশু আমাদের জন্যে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। (১যোহন ৩:১৪-১৬)। “যে-কেউ ঈশ্বরের সমস্ত আদেশ মেনে চলে, সে তো তার আশ্রয়ে বাস করে আর তিনিও তার অন্তরে বাস করেন। তিনি যে আমাদের অন্তরে বাস করেন, আমরা এই ভাবেই তা বুঝতে পারি আর তা বুঝতে পারি সেই পবিত্র আত্মারই জন্যে, যে পবিত্র আত্মাকে তিনি আমাদের অন্তরে দিয়েছেন” (১ যোহন ৩:২৪)। ভালোবাসা হলো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তা যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণের ধার ধারে না। 

    সাধু যোহন আরো বলেন: “ভালোবাসা ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে। যারা ভালোবাসে তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান, তারা সবাই ঈশ্বরকে  জানে। ভাল যে বাসে না, সে ঈশ্বরকে জানে না, কারণ ঈশ্বর তো প্রেমস্বরূপ! .. . ঈশ্বরকে কেউ কোনদিন দেখেনি, তবে আমরা যদি পরস্পরকে ভালোবাসি, তাহলে ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাদের অন্তরে রয়েছেন এবং ঈশ্বর-প্রেমও আমাদের অন্তরে পূর্ণতা লাভ করেছে। ... . . ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ। ভালোবাসায় যার আবাস, সে বাস করে ঈশ্বরের আশ্রয়ে আর ঈশ্বর-ও তার অন্তরে বাস করেন” (১যোহন ৪:৮, ১৬খ)।    

    প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মানবিক ভাষার ব্যবহার মানুষের জন্য অপরিহার্য, কেননা দৈব বা স্বর্গীয় ভাষা তার আয়ত্তের মধ্যে নেই। সুতরাং মানবীয় অভিজ্ঞতার অতীত সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে মানুষকে পবিত্র আত্মা বা পাক-রূহের সাহায্য গ্রহণ করা অপরিহার্য। সাধু পল বলেন: “আমরা যথোচিতভাবে প্রার্থনা করতে জানি না, কিন্তু স্বয়ং পবিত্র আত্মা আমাদের হয়ে অনির্বচনীয় আকুলতায় আবেদন জানিয়ে থাকেন”(রোমীয় ৮:২৬)। “যারা পবিত্র আত্মার প্রেরণা মেনে নিয়েই জীবন যাপন করে, তাদের অন্তর ছুটে যায়, যা-কিছু আধ্যাত্মিক, সেই দিকে” (রোমীয় ৮:৫)।  প্রকৃত যোগী বা ধ্যানী ব্যক্তি সেই আত্মার সাথে যুক্তাত্মা হতে পারেন বলেই তার মধ্যে ঈশ্বরোপলব্ধি জাগে। যীশু তাই একবার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন:“হে পিতা,  হে স্বর্গমর্ত্যের প্রভু, আমি তোমার বন্দনা করি কারণ (ঐশ রাজ্যের) এই সমস্ত কথা তুমি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদের কাছে গোপন রেখেছ আর প্রকাশ করেছ নিতান্ত শিশুদেরই কাছে। . . এতেই ছিল তোমার আনন্দ!” (লুক ১০:২১)। 

    মানুষের মাঝে মানুষরূপে ঈশ্বরাভিজ্ঞতা করার উপায় হচ্ছে নম্রতা ও ভালোবাসা। ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ। তাই তাকে দেখা বা অভিজ্ঞতা করা সম্ভব একমাত্র ভালোবাসার মাধ্যমে। প্রেমহীন দৃষ্টি নিয়ে প্রেমস্বরূপ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করার সম্ভব নয়। সাধু পল বলেন: “তোমাদের মনোভাব তেমনটি হওয়া উচিত, যেমনটি খ্রিস্টযীশুর নিজের ছিল। তিনি তো স্বরূপে ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরের সঙ্গে তার সমতুল্যতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেন না, বরং নিজেকে তিনি রিক্ত করলেন; দাসের স্বরূপ গ্রহণ করে তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন। আকারে-প্রকারে মানুষের মতো হয়ে তিনি নিজেকে আরও নমিত করলেন। চরম আনুগত্য দেখিয়ে তিনি মৃত্যু, এমন কি ক্রুশেই মৃত্যু মেনে নিলেন, যেন যীশুর নামে আনত হয় প্রতিটি জানু  স্বর্গে, মর্ত্যে ও পাতালে প্রতিটি জিহ্বা যেন এই সত্য ঘোষণা করে : যীশুখ্রিস্ট স্বয়ং প্রভু, আর এতেই প্রকাশিত হয় পিতা ঈশ্বরের মহিমা” (ফিলিপ্পীয় ২:৫-১১)। জাগতিক জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য এক্ষেত্রে নিতান্ত অসহায় ও  বিপন্ন। সহজ কথায় লোকে যেমন বলে: “মোল্লার দৌড় মজিদ পর্যন্ত।” মহাজ্ঞানী সাধু টমাস আকুনাসও ঈশ্বরের উপস্থিতি প্রমাণ করতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে বলেছিলেন: যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তার কাছে প্রমাণের কোন প্রয়োজন নেই, কেননা তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, আর যে লোক বিশ্বাস করে না, তার কাছে হাজারো প্রমাণ হাজির করলেও সে বিশ্বাস করবে না। 

    বিষয়টি হয়তো এভাবেও ধ্যান করা যায়: মানুষের দেখা হয় বিচিত্র উপায়ে: দৈহিক চক্ষু ও অন্তর্চক্ষু দিয়ে, দৈহিক দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। কবিগুরু বলেছিলেন: “নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।” ঈশ্বর তো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। সুতরাং তাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করার বাসনা কখনো পূর্ণ হবার নয়। ঈশ্বর ভালোবাসা। মানুষকে সেই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যে ভালোবাসে না সে কখনো ঈশ্বরকে দেখতে পাবে না। পিতা বা মাতা যে না হয়েছে তার মধ্যে সন্তানের প্রতি  পিতৃস্নেহ বা মাতৃস্নেহ পরোক্ষ অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ, অন্যকে রসগোল্লা খেতে দেখে রসগোল্লার স্বাদ গ্রহণ করার মতো।

    কিন্তু ব্যক্তিজীবনে গভীরভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে বিশ্বময় বিরাজিত বিশ্বপ্রভুকে অন্তরে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করা, অর্থাৎ নিজ অন্তরে তার জন্মলাভ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা করাই তো মানুষের চিরন্তন আকাক্ষা। তিনি তো বিশ্বময়, তিনি সর্বব্যাপী। আদিতে ছিলেন বাণী, বাণী হলেন দেহ। আমারই অন্তরে  তার দেহধারণ। আনন্দ স্বভাবতঃই উপচে পড়ে। প্রফুল্লচিত্ত ব্যক্তির চোখে-মুখেই আনন্দের অভিব্যক্তি। কেননা অন্তরের অকপট উপলব্ধিই মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও মুখাবয়বে প্রকাশ পায়। তাছাড়া প্রকৃত আনন্দ প্রতিনিয়ত বিস্তার ও প্রকাশের পন্থা ও ভাষা খুঁজে বেড়ায়। এভাবে আনন্দের বন্যা বা লহরী সৃষ্টি হয়। সেই বন্যায় প্লাবিত হয়েই মানুষের মনের কলুষ-কালিমা ধৌত হয়ে নতুন ভাবের উদয় হয়। একটি নবজাগরণ সৃষ্টি হয়।

    বড়দিন অর্থাৎ যীশুখ্রিস্টের জন্মোৎসব আনন্দের উৎসব। এ দিনে আমরা সহাস্যে পরস্পরকে সম্বোধন করি, পরস্পরের শুভ কামনা করি, বিশ্বের সকল মানুষ ও সকল প্রাণীর সার্বিক মঙ্গল প্রার্থনা করি। আনন্দের স্বাভাবিক ধর্ম-ই তাই। বড়দিনের বিশেষ বার্তাটি হচ্ছে: “ভয় পেয়ো না! আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। ... ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে!” (লুক ২:১০,১৪খ)। অন্য কথায়, অশুভ শক্তির অস্তিত্ব অনস্বীকার্য,  কিন্তু শুভশক্তি ও সত্যের জয় চিরকালই অবশ্যম্ভাবী ও সুনিশ্চিত। 
    শিশুসুলভ সরলতা, নম্রতা, পবিত্রতা সকল মানুষের মধ্যেই কাম্য। কিন্তু পাপময় পৃথিবীতে মানুষের মাঝে পুঞ্জীভূত অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন, পাপ-পঙ্কিলতা, অহংকার, লোভ-লালসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও যুদ্ধবিগ্রহের ফলে মানব পরিবারের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব,  শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সুসম্পর্কের পরিবর্তে দেখা দেয় যুদ্ধ-বিগ্রহ, সহিংসতা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ। এভাবে মানব-পরিবারে দেখা দেয় বিবাদ-বিচ্ছেদ ও সংঘর্ষ। এসব তো কখনো সভ্য জগতে সভ্য মানুষের আচরণ হতে পারে না। 
    পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা বিশ্বসৃষ্টির প্রভু। তিনি সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারাকে চমৎকার নিয়মের বাধনে বেঁধে দিয়েছেন বলেই তারা নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। সেখানে কোটি কোটি বছরে কদাচিৎ কোন লক্ষ্যভ্রষ্টতা বা কক্ষচ্যুতি দেখা যায়। অনুরূপভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মধ্যে তিনি বিবেক নামক মানদণ্ড দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে যদি সত্যিকার বিবেকবোধ জাগ্রত হয় এবং তা সক্রিয় থাকে তবেই সেখানে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় থাকবে। সেরূপ মানবসমাজ বিনির্মাণের লক্ষেই আমাদের সব উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন। বড়দিন ও নববর্ষ উৎসব পালনের উদ্দেশ্যও তাই।   

    লেখক : উপাচার্য  (ভারপ্রাপ্ত) নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS