মরিয়মের সঙ্গে যোষেফের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বিবাহ এর পূর্বেই জানা গেল, মরিয়ম পবিত্র আত্মার প্রভাবে গর্ভবতী হয়েছেন। তাঁর ভাবী স্বামী যোষেফ ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি। তিনি মরিয়মকে লোক চক্ষে হেয় করতে চাইলেন না। তাই গোপনে তাঁকে ত্যাগ করার সংকল্প করলেন। এই সমস্যা নিয়ে তিনি যখন বিব্রত সেই সময়ে ঈশ্বর প্রেরিত দূত স্বপ্নে তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, ওহে ডেভিড পুত্র যোসেফ, মরিয়মকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধা করো না, কারণ পবিত্র আত্মার প্রভাবেই সে গর্ভধারণ করেছে। তার একটি পুত্র সন্তান হবে, তুমি তার নাম রেখো যিশু, কারণ তিনি তাঁর প্রজাদের পাপের কবল থেকে উদ্ধার করবেন। (Matthew 1:18-21)
প্রতাপশালী রাজা হেরোদের আমলে যিহুদীয়া বেথলেহেম শহরে যিশুর জন্ম হয়। সেই সময়ে প্রাচ্য থেকে কয়েকজন জ্যোতিষী জেরুজালেমে এলেন। তাঁরা জানতে চাইলেন। ইহুদিদের যে রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি কোথায়? প্রাচ্যের আকাশে তাঁর জন্মের প্রতীক তারার উদয় আমরা দেখেছি। আমরা এসেছি তাঁকে প্রণাম করতে। (Matthew 2:1-2)
প্রতাপশালী হেরোদ তখন সেই জ্যোতিষীদের গোপনে ডেকে তাঁদের কাছ থেকে বিশেষ ভাবে জেনে নিলেন, সেই তারাটি ঠিক কোন সময়ে দেখা গিয়েছিল। তারপর তিনি তাঁদের বেথলেহেমে পাঠিয়ে দিলেন, আর বলে দিলেন, আপনারা সেখানে গিয়ে ভাল করে শিশুটির খোঁজ নিন এবং আমাকে এসে জানান যেন আমিও গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে পারি। এরপর হেরোদের কাছে ফিরে না যাবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে অন্য পথ ধরে তাঁরা স্বদেশে ফিরে গেলেন। (Matthew 2:7-8)
জ্যোতিষীরা চলে যাবার পর ঈশ্বরের দূত স্বপ্নে দেখা দিয়ে যোসেফকে বললেন, “যোসেফ, ওঠো, শিশুটি ও তাঁর মাকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যাও। আমার আদেশ না পাওয়া পযর্ন্ত তুমি সেখানেই থাকবে। কারণ শিশুটিকে হত্যা করার জন্য হেরোদ তাঁর সন্ধানে তৎপর হবে। (Matthew 2:13)
প্রতাপশালী রাজা হেরোদ যখন বুঝতে পারলেন যে প্রাচ্যের জ্যোতিষীরা তাঁকে প্রতারণা করেছেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি তখনই সৈন্য পাঠিয়ে বেথলেহেম ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে দু’বছর ও তার কম বয়সের যত শিশুপুত্র ছিল তাদের সকলকে হত্যা করলেন। জ্যোতিষীদের কথামত তিনি এই বয়সেরই হিসাব করেছিলেন। (Matthew 2:16)
রাজা হেরোদের মৃত্যুর পর প্রভুর এক দূত মিশরে যোসেফকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, যোসেফ, শিশুটি ও তাঁর মাকে নিয়ে এখনি ইসরায়েল দেশে ফিরে যাও। কারণ শিশুটির প্রাণনাশের চেষ্টা যারা করেছিল তাদের মৃত্যু হয়েছে। যোসেফ তখন তাঁদের নিয়ে ইসরায়েল দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন যে আর্কেলাউস তাঁর পিতা হেরোদের স্থলে ইহুদিয়া প্রদেশে রাজত্ব করছেন। তাই সেখানে যেতে তিনি ভয় পেলেন। স্বপ্নেও তিনি এ সম্বন্ধে সতর্কবাণী পেলেন। তিনি গালীল প্রদেশে চলে গেলেন এবং নাজারেথ নামে এক জনপদে বাস করতে লাগলেন। (Matthew 2:19-23)
সেই সময়ে যিশু ব্যাপ্তিস্ম (ব্যাপ্টিস্ট হওয়ার দীক্ষা) নেবার জন্য গালীল থেকে জর্ডন নদীর তীরে যোহনের কাছে এলেন। যোহনের তাতে সম্মতি ছিল না, বলেছিলেন- আমারই তো উচিত আপনার হাতে ব্যাপ্তিস্ম গ্রহণ করা, আর আপনি এসেছেন আমার কাছে ! কিন্তু যিশু তাঁকে বললেন, এখন এ রকম হওয়াই সঙ্গত। কারণ এভাবেই ঈশ্বরের বিধান আমাদের পালন করতে হবে। যোহন তখন সম্মত হলেন। ব্যাপ্তিস্মের পর যিশু জল থেকে উঠে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং তিনি দেখলেন ঈশ্বরের আত্মা কপোতের মত নেমে এসে তাঁর উপরে অধিষ্ঠিত হলেন। (Matthew 3:13-16)
সামন্ত রাজ হেরোদ (প্রতাপশালী রাজা হেরোদ পুত্র) যিশুর খ্যাতি শুনতে পেয়ে তাঁর সভাসদদের বললেন, ইনিই ব্যাপ্তিস্ম দাতা যোহন, ইনি মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন, তাই এই সমস্ত অলৌকিক শক্তি তাঁর মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সামন্ত রাজ হেরোদ তাঁর ভাই ফিলিপের স্ত্রী হেরোদিয়ার জন্য যোহনকে গ্রেপ্তার করেছিলেন এবং শৃঙ্খলিত করে তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। যোহন তাঁকে বলেছিলেন, ভ্রাতৃবধূকে গ্রহণ করা আপনার উচিত হয়নি। হেরোদ তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনসাধারণের ভয়ে তিনি রাজী হননি। কারণ তারা যোহনকে ঈশ্বরের দূত বলে মান্য করত। হেরোদের জন্মদিনে হেরোদিয়ার কন্যা দরবারে নেচে হেরোদকে খুশি করেছিল। তিনি শপথ করে এই কথা দিলেন, ভ্রাতুস্পুত্রী মেয়েটি যা চাইবে তিনি তাকে তাই দেবেন। তার মায়ের পরামর্শে মেয়েটি বলল, যিশুর ব্যাপ্তিস্মদাতা যোহনের মাথাটি একটি থালায় করে আমাকে এনে দিন। রাজা এতে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন, কিন্তু নিজের শপথের কথা এবং আমন্ত্রিতেরা কি মনে করবেন, তাই ভেবে তিনি আদেশ দিলেন। কারাগারে লোক পাঠিয়ে যোহনের মস্তক ছেদন করে থালায় নিয়ে আসা হল মাথাটি, মেয়ে তার মার কাছে নিয়ে গেল সেটি। (Matthew 14:1-11)
তিনি যখন কথা বলছিলেন সেই সময়ে উজ্জ্বল একখণ্ড মেঘ এসে তাঁদের ঢেকে ফেলল এবং সেই মেঘের মধ্য থেকে এই বাণী ঘোষিত হল, ’ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, আমার পরম প্রীতিভাজন , তাঁর কথা শোন’। এই কথা শুনে শিষ্যেরা ভয়ে অভিভূত হয়ে মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। যিশু কাছে এসে তাঁদের স্পর্শ করে বললেন, ওঠ, ভয় করো না। তাঁরা তখন তাকিয়ে দেখলেন, যিশু ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। পাহাড় থেকে নেমে আসার সময়ে যিশু তাঁদের এই আদেশ দিলেন, মানবপুত্র যতদিন না মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হন ততদিন এই দর্শনের কথা তোমরা কাউকে বলো না। (Matthew 17:5-9)
তাঁরা সকলে যখন গালীল পরিভ্রমণ করছিলেন তখন যিশু তাঁদের বললেন, মানবপুত্রকে মানুষের অধীনে সমর্পণ করা হবে । তারা তাঁকে হত্যা করবে কিন্তু তৃতীয় দিনে তিনি পুনরুত্থিত হবেন। এ কথা শুনে শিষ্যরা অত্যন্ত বিষন্ন হলেন। (Matthew 17:22-23)
যিশু জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন সমস্ত নগরে এক মহা আলোড়নের সৃষ্টি হল। লোকে জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি? জনতা উত্তর দিল তিনিই নেজারতের সেই ঈশ্বর প্রেরিত দূত , ইনিই যিশু! যিশু মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরের মধ্যে যারা বেচাকেনা করছিল তিনি তাদের সকলকে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি অর্থ লেনদেন কারীদের টেবিল ও ঘুঘু ব্যাপারীদের আসন উলটিয়ে ফেলে দিলেন। তাদের বললেন, শাস্ত্রে লেখা আছে, ‘এই গৃহ প্রার্থনা ভবন রূপে গণ্য হবে’, কিন্তু তোমরা একে দস্যুর আস্তানায় পরিণত করেছ। মন্দিরে মধ্যে অন্ধ ও খোঁড়া কিছু লোক তাঁর কাছে এল, তিনি তাদের সুস্থ করে দিলেন। প্রধান পুরোহিত ও শাস্ত্রীরা তাঁর অলৌকিক কাজ দেখে এবং মন্দিরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের যিশুর পক্ষে চিৎকার শুনে খুব ক্রুদ্ধ হলেন। (Matthew 21:10-15)
ভণ্ড শাস্ত্রী ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের! তোমরা লোকের সামনে স্বর্গরাজ্যের দরজা বন্ধ করে দাও। নিজেরা তো প্রবেশ করই না, যারা চায় তাদেরও ঢুকতে দাও । ধিক তোমাদের ! তোমরা বিধবাদের বিষয়-সম্পত্তি গ্রাস কর, অথচ ধর্মের ভাণ করে লম্বাচওড়া প্রার্থনা আওড়াও, এজন্য বিচারে তোমাদের আরও গুরুতর শাস্তি হবে । ভণ্ড শাস্ত্রবিদ ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের! একটি লোককে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টায় তোমরা জলে স্থলে ঘুরে বেড়াও, আর কাউকে যদি তা করতে পার তাহলে তোমরা তাকে নিজেদের চেয়েও বড় পাষণ্ড করে তোল। ( Matthew 23:13-15)
তাঁর বারোজন শিষ্যের অন্যতম যিহুদা এসে উপস্থিত হল। তার সঙ্গে ছিল প্রধান পুরোহিত ও সমাজপতিদের পাঠানো একদল লোক। তাদের হাতে ছিল তরোয়াল ও লাঠি। সেই বিশ্বাসঘাতক তাদের এই সঙ্কেত দিয়ে বলেছিল, আমি যাকে চুম্বন করব, সে-ই হল ঐ লোক। তোমরা গিয়ে তাকে ধরবে। সে সোজা যিশুর কাছে এগিয়ে এসে তাঁকে সম্ভাষণ জানাল, গুরুদেব, মঙ্গল হোক আপনার! তারপর সে তাঁকে চুম্বন করল। যিশু তাকে বললেন, বন্ধু যা করতে এসেছ করে ফেল। তারা তখন এগিয়ে এসে যিশুকে গ্রেপ্তার করল। (Matthew 26: 47-50)
তারপর রাজ্যপালের সৈন্যরা যিশুকে রাজভবনে সৈন্যাবাসে নিয়ে গেল এবং সমগ্র সেনাদল তাঁর চারপাশে জড়ো হল। তাঁর জামাকাপড় খুলে নিয়ে তারা তাঁকে একটি গাঢ় বেগুনী পোষাক পরিয়ে দিল। একটি কাঁটার মুকুট গেঁথে তারা তাঁর মাথায় বসিয়ে দিল আর তাঁর ডান হাতে তুলে দিল একটি লাঠি। তাঁর সামনে তারা নতজানু হয়ে উপহাস করে বলতে লাগল, ইহুদী রাজের জয় হোক! তারা তাঁর গায়ে থুতু দিল এবং সেই লাঠি দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করল। এইভাবে বিদ্রূপ করার পর তারা তাঁর গায়ের সেই পোষাক খুলে নিল, আবার তাঁকে তাঁর নিজের জামাকাপড় পরিয়ে তাঁকে ক্রুশে দেবার জন্য নিয়ে চলল। সেখানে তাঁকে তিক্ত দ্রাক্ষারস পান করতে দিল, কিন্তু একটু আস্বাদন করে তিনি তা পান করতে চাইলেন না। তারপর তাঁরা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করল এবং তাঁর জামাকাপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। (Matthew 27: 27-31,34)
যিশু উচ্চকন্ঠে চীৎকার করে প্রাণত্যাগ করলেন। তখনই মন্দিরের যবনিকা উপর থেকে নীচু পর্যন্ত ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে গেল, ভূমিকম্প হল, পর্বত বিদীর্ণ হল । সমাধিগুলি খুলে গেল, বহু মৃত পুণ্যাত্মার দেহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল,এবং যিশুর পুনরুত্থানের পর সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা পুণ্য নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন। (Matthew 27: 50-31)
তাঁর দেহ ছিল বিদ্যুতের মত, তাঁর পোষাক ছিল তুষারশুভ্র। যারা পাহারা দিচ্ছিল তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ল। স্বর্গদূত মহিলাদের উদ্দেশ করে বললেন, ভয় পেয়ো না, আমি জানি, তোমরা ক্রুশে নিহত যিশুকে খুঁজছ। তিনি এখানে নেই, তাঁর কথা মতই তিনি পুনরুত্থিত হয়েছেন। এসো, যেখানে তিনি শায়িত ছিলেন সেই স্থানটি দেখ। তাঁর শিষ্যদের সত্বর সংবাদ দাও যে তিনি মৃতলোক থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং তোমাদের আগেই গালীলে যাচ্ছেন। তোমরা সেখানেই তাঁর দেখা পাবে, এই আমার বক্তব্য। ভয়ে ও গভীর আনন্দে উদ্বেল হয়ে তাঁরা সমাধিস্থল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটে চললেন শিষ্যদের সংবাদ দিতে। হঠাৎ যিশু এসে তাঁদের সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক। তাঁরা কাছে গিয়ে তাঁর পা দু’খানি জড়িয়ে ধরে তাঁকে প্রণাম করলেন। (Matthew 28: 3-9)