প্রভুর দাস প্রিয়নাথ বৈরাগীর জীবনী

ads20
    Priyonath Boiragee (প্রিয়নাথ বৈরাগী) 
    ১৮৮৬ সালের ৩রা জুন। এই দিন বরিশাল জেলার ইন্দুরকানী গ্রামে প্রাইমারী মিশন স্কুলের শিক্ষক শ্রীনাথ বৈরাগীর গৃহে এক নব অতিথির আগমন হয়। চারিদিকে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়- প্রতিবেশীরা আন্দোচ্ছলিত হৃদয়ে গ্রহভ্যন্তরে আনাগোনা করতে আরম্ভ করেন, চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে যায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শ্রীনাথ বৈরাগী মহাশয় ফুলের মতো সুকুমারমৃখশ্রী সম্পন্ন একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছেন এই শিশুই পরবর্তীকালে বিভিন্ন গুণে আপন বহুমূখী প্রতিভায়, দেহিক সৌন্দর্যে, তেজে, পরাক্রমে, ন্যায় ও ধর্মনিষ্ঠায়, আধ্যাত্মিক অনুভূতির নব নব প্রকাশে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। ইনিই স্বনামধন্য ভক্ত প্রিয়নাথ বৈরাগী।প্রিয়নাথ পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান সূর্যকুমারের মৃত্যু হয় মাত্র তিন বছর বয়সে জলে ডুবে। প্রথম সন্তানের এই শোচনীয় মৃত্যু তীব্র বেদনার আঘাত হেনেছিল পিতামাতার বক্ষে। তাদের অসহায় বেদনার আর্তি পরমপিতার কর্ণগোচর হয়েছিল। তিনি এই পরিবারে আশীর্বাদ স্বরূপ দ্বিতীয় সন্তান প্রেরণ করেন। গৃহ আবার হাস্যোজ্বল হয়ে ওঠে।পরে প্রিয়নাথের পূর্বপুরুষের যে ইতিহাস জানা যায় তা এই রূপ- প্রিয়নাথের পিতামহের পিতামহ ছিলেন বরিশাল জেলার প্রখ্যাত গ্রাম গৈলার অধিবাসী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, সত্যনিষ্ঠ, নির্ভক ও দৃঢ়চিত্ত। নির্ভীকভাবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে তিনি কখনও ইতঃস্ত করেননি।বন্দ্যোপাধ্যায় গোষ্ঠীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তখনকার দিনের সামাজিক অনুশাসন ছিল অত্যন্ত কঠোর। অনেক সামাজিক বিধিবিধানের মধ্যে যে অন্যায় অযৌক্তিকতা ছিল, তা তাঁর মনেকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি তাঁর আঘাত লেগেছে যখন তিনি দেখেছেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে- তাদের ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। যৌবনে তিনি এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন। সমাজের অনুশাসন যে তিনি মানেন না, সেটা স্পষ্ট করে সমাজকে দেখাবার জন্যই ব্রাহ্মণ হয়েও এক বৈদ্য কন্যাকে বিবাহ করেছেন ও সমাজ প্রদত্ত শাস্তিকে অবহেলা করে বৈষ্ণব হয়েছেন এবং পিতৃপুরুষের বদ্যোপাধ্যায় পদবী ত্যাগ করে কয়েক মাইল তফাতে তরুনসেন গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর তিন পৌত্র- ভজন বৈরাগী, কাঁলাচাঁদ বৈরাগী ও নীলকমল বৈরাগী। এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে ধর্মভাব ছিল প্রবল এবং এঁদের মুগ্ধ করে এবং তিন ভাই-ই খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।প্রিয়নাথ জেষ্ঠ ভজন বৈরাগীর পৌত্র। ভজন বৈরাগী খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার পরে সংগীতের মাধ্যমেই খ্রীষ্টকে প্রচার করেছেন। শ্রীরামপুর কলেজের প্রাচীন নথিপত্র থেকে পাওয়া যায় তিনি একতারা বাঁজিয়ে গান করে খ্রীষ্টনাম প্রচার করেছেন। শোনা যায়, তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন সে যুগের শিক্ষিতা মহিলা। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্না ছিলেন তিনি। সমস্যাপীড়িত বহু নারী-পুরুষ এসে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতেন। অন্তঃপুরের নারীরা যাতে অক্ষর পরিচয় লাভ করেন এবং তাঁদের ঈশ্বর সম্বন্ধীয় জ্ঞান জন্মে, সে চেষ্টা তিনি সব সময় করেছেন এবং বহু ক্ষেত্রে কৃতকার্যও হয়েছেন।প্রিয়নাথের মা স্বর্ণকুমারী ছিলেন অনন্যসাধারণ সুন্দরী মহিলা। বধুবেশে যখন তিনি শ্রীনাথের সংসারে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল বারো বছর। তাঁর সৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিকে এত ছড়িয়ে পড়েছিল যে বহুদূরদূরান্ত থেকে মেয়েরা তাঁকে দেখতে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে আসত। এঁর স্বভাবটি ছিল অতি মধুর। অতি ধীর এবং নম্র ছিলেন তিনি, কথাবার্তা তিনি সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পারতেন এবং কথার ধরণে বোঝা যেত ইনি কবিত্ব শক্তিসম্পন্না। এই বংশের কয়েকটি বিশেষত্ব এই যে, পুরুষানুক্রমে এঁরা সুন্দর গৌরবর্ণবিশিষ্ট িএবং আকর্ষনীয় দৈহিক সৌন্দর্য সম্পন্ন, সাহিত্য ও সংগীতে এঁদের প্রতিভা উল্লেখযোগ্য এবং উচ্চ আধ্যাত্মিকভাবপন্ন। শোনা যায়, শ্রীনাথ বৈরাগী অনেক সুন্দর সুন্দর সংগীত রচনা করেছিলেন- কিন্তু দুঃখের বিষয় সে সবের সঞ্চয় কেউ যত্নপূর্বক রক্ষা করেনি বলেই তা কালগ্রাসে পতিত হয়েছে।সে যুগে পূর্ববঙ্গে অন্যতম শ্রেষ্ঠ খ্রীষ্টসন্তান ছিলেন অনুণোদয় ঘোষ মহাশয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই পুরুষ আধ্যাত্মিকতার যে ধারা বহন করে এনেছিলেন, তার অনেকখানি প্রভাব পড়েছিল প্রিয়নাথের উপরে। ইনি শ্রীনাথ বৈরাগীর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং এই পরিবারের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রিয়নাথ ছোটবেলা থেকেই অরুনোদয় ঘোষের অপূর্ব ধর্মবিশ্বাস, প্রার্থনার শক্তি ও চরিত্রের দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর সে সম্বন্ধে প্রিয়নাথ যে সব কথা বলতেন, তা থেকে বোঝা যেত ঘোষ মহাশয়কে কতটা বুঝেছিলেন তিনি এবং তাঁর প্রভাব কতটা পড়েছিল প্রিয়নাথের উপরে। অরুণোদয় ঘোষের সুযোগ্য পুত্র অনুকূল চন্দ্র ঘোষ প্রিয়নাথকে এত স্নেহ করতেন যে, প্রিয়নাথ তাঁকে পিতা বলে সম্বোধন করতেন।এই বংশে যে আধ্যাত্মিকতার ধারা প্রবাহিত ছিল, তা পরিণতি লাভ করে শ্রীনাথ বৈরাগীর পুত্রকন্যাদের মধ্যে। প্রিয়নাথের পরে কন্যা বিধুমুখী, তারপরে ক্রমানুসারে পুত্র অতুল, উত্তম ও সুবোধ। অত্যান্ত বেদনার কথা প্রিয়নাথ ব্যতীত এঁরা প্রত্যেকেই কীটদগ্ধ অর্ধস্ফুট কুসুমের মতো, পূর্ণ প্রস্ফুটিত হবার আগেই অতি কলালে একে একে বিদায় গ্রহণ করেন। কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়েছিল পাশের গ্রামের সুখলাল সমাদ্দার মহাশয়ের সঙ্গে। রূপে গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সাঁইত্রিশ কি আটত্রিম বছর বয়সে ছয়টি পুত্র কন্যা রেখে তাঁকে এ জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হয়। অতুল, উত্তম ও সুবোধ আঠারো থেকে কুড়ি বছর বয়সেই একে একে পরলোকগমন করেন।এই ঘটনার কয়েক বছর আগে কলকাতায় একবার নিখিল বঙ্গ ধ্রূপদ সংগীত প্রতিযোগিতা হয়। উত্তম তখন এগার বছর বয়সের বালকমাত্র। তিনি এতে প্রতিযোগী হিসাবে নাম দেন। এই প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিনকার সেই এগার বছরের বালক উত্তম যখন তাঁর অপূর্ব মধুক্ষরা কণ্ঠে গান ধরলেন, তখন সভাশুদ্ধ লোক স্ত্বম্ভিত। কি গলা, কি অপূর্ব ব্যঞ্জনা! গান শেষ করে অন্তরার মুখ ধরতে যাবেন, সেই অবসরে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সমস্ত লোক হাততালিসহ জয়ধ্বনি করে ওঠে। ছোট্ট বালক তাতে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে থেমে যান, কিন্তু পরমুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যখন তিনি অন্তরা ধরেন, তখন এক মাত্রা এদিক ওদিক হয়ে যেতে তালে গোলমাল হয়। সেই ত্রুটির জন্য তাঁকে প্রথম স্থান না দিয়ে দ্বিতীয় স্থান দেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একেবারে কোলে টেনে নেন। কোলে বসিয়ে তাঁকে বললেন “তুমি অপূর্ব গেয়েছ…. তোমার গান আরও শুনব।”প্রিয়নাথের মানসিক গঠন এরূপ ছিল যে, তিনি তাঁর জীবনের দুঃখের কিম্বা সুখের স্মৃতি কোনদিন ভুলতে পারতেন না। মানুষের অন্যায় দুর্ব্যবহার তাঁর অন্তরে শেলের মত বিধত এবং সেই বেদনার স্মৃতি জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁকে কাঁটার খোঁচা দিয়ে যেত, তিনি তা থেকে রেহাই পেতেন না। তিনি নিজে থেকে কারও সঙ্গে সামান্যতম দুর্ব্যবহারও করতেন না। অসাধারণ বিনয়ী ছিলেন তিনি, নিজেকে সর্বসময় প্রচ্ছন্ন রাখতেন। তাঁর বিনয় তাঁর কথায় যতটা না প্রকাশ পেত, ববহারে তার চেয়ে অনেক বেশী দেখা যেত। তাঁর জীবনে যে কত অন্যায় আচরণ, দুর্ব্যবহার মানুষের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন, তার শেষ নেই, কিন্তু সেসব ব্যথাকে ছাপিয়ে উঠেছিল ঈশ্বরের সঙ্গে সহভাগিতার আনন্দে। যখন তিনি সময় পেতেন প্রার্থনায় বসতেন এবং সে প্রার্থনা অতি গভীরভাবে তাঁর চিত্ত-আত্মাকে আলোড়িত করে তুলত, বাহ্য জ্ঞান তাঁর লোপ পেত। সেসময় তাঁর প্রার্থনার ভাষা, গলার স্বর এবং মুখের ভাব যারা লক্ষ্য করেছেন, তারা বুঝতে পারতেন ঈশ্বরের সঙ্গে কতখানি একাত্মতা তিন অনুভব করছেন। ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার আনন্দ তাঁর সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল, তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিল। সব পাওয়ার শেষ পাওয়া- সেই পরম পাওয়াকে তিনি পেয়েছিলে এবং তা তাঁর জীবনকে ধন্য করে দিয়ে স্বর্গীয় আশীর্বাদের অজস্রতায় ভরিয়ে তুলেছিল।শৈশবে ও বাল্যে প্রিয়নাথ মিশন স্কুলে পড়াশোনা করেন। শ্রীরামপুর মিশন বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং উপযুক্ত সময়ে এফ. এ (বর্তমান আই. এ) পাশ করেন। পরিবারে মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়ায় এসময়ে প্রিয়নাথের উপরেই সংসারের দ্বায়িত্ব এসে পড়ে। ফলে তাঁকে চাকরীর সন্ধানে ইতস্তত ঘুচাতে হয়। অল্পদিনের মধ্যে সুন্দরবনের বন বিভাগে (কর) চাকরী পেয়ে তিনি সুন্দরবন অঞ্চলে চলে যান।এদিকে বনকর বিভাগে প্রিয়নাথকে নানা দুর্ণিতি উৎকোচ ইত্যাদির সম্মুখিন হতে হয় এবং এতে তিনি অত্যান্ত মর্মপীড়া অনুভব করেন। কিছুদিনের মধ্যে দুর্ণিতিগ্রস্থ চাকরীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি সে চাকরী ছেড়ে দেন।এরপর তিনি নোয়াখালীতে একটি মিশন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। এখানে সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে এগারটা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। সমস্ত দুপুরে ও বিকেলে তাঁর হাতে কোন কাজ থাকত না। এই সময় তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রতিদিন প্রার্থনায় দীর্ঘসময় অতিবাহিত করতেন। তাঁর জীবনের সায়াহ্নে নোয়াখালী থাকাকালীন এ সময়ের অভিজ্ঞতা একদিন ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথমদিকে তাঁর প্রার্থনায় গভীর মনোসংযোগ হত না। কিন্তু প্রতিদিন নিয়মিত বসার পরে মনোসংযোগ গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। এর পরে প্রার্থনায় বসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে শিহরণ ও রোমাঞ্চ দেখা দিত এবং রক্তে এক অপূর্ব দোলা অনুভূত হত। সমগ্র দেহ দ্রুত স্পন্দিত হত এবং সেই সঙ্গে এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দের বেগে সমগ্র দেহমন প্রবলভাবে আলোড়িত হতে থাকত। আনন্দের এই তীব্রবেগ ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। শেষের দিকে তিনি দৃশ্য দেখতে পেতেন.. নানা বর্ণালী রেখা তাদের অসামান্য সৌন্দর্যমহিমার অপরূপ মায়া নিয়ে তাঁর দিশেহারা চোখে ধরা দিত। অপার্থিব সঙ্গীত তাঁর শ্রুতিগোচর হত। যে অশ্রুতপূর্ব রাগিনী তিনি শুনতে পেতেন, তা বর্ণনাতীত। বোধ হয় তাঁর সেই সময়েরই রচনা-
    “ঐ শোনা যায় ওপারের গান সংগীত ধ্বনি অমুরপুরে
    স্বর্গের দূতের বীণায় তান উঠেছে ভাই
    মধুর যীশু নামে আকাশ জুড়ে।”
    প্রিয়নাথ বলতেন, আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন স্তর বেয়ে যখন মানুষ অগ্রসর হয়, তখন এসব অনুভূতি একের পর এক আসে এবং সেই সঙ্গে আসে প্রবল সাহস, প্রভূত আত্মবিশ্বাস এবং বোঝা যায় ঈশ্বরের শক্তি ধীরে ধীরে তার উপরে নেমে আসছে। এসময়ে গলার স্বর, চোখের চাহনি মুখের ভাব পর্যন্ত অন্যরকম হয়ে যায়।
    নোয়াখালির এ দিনগুলির অনুভূতি প্রিয়নাথের জীবনে স্বর্বস্তরের আধ্যাত্মিকত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এই সময়ে তিনি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সদাপ্রভুর অপার মহিমা অনুভব করেন এবং বুঝতে পারেন, এটাই মানবের একমাত্র পথ। এ জগতের যা কিছু সুখ, আনন্দ, মানব জীবনের যা কিছু বাঞ্ছিত তা পাওয়ার পূর্ণতায় ভরিয়ে তোলার এটাই একমাত্র উপায়। এই-ই শাশ্বত, চিরন্তন …. এই-ই অনন্ত জীবনের স্বাদ।
    এই সঙ্কল্প নিয়ে সম্ভবত ১৯১৫ সালে তিনি শ্রীরামপুর কলেজে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষালাভের জন্য আসেন। তখন স্বনামধন্য ডাঃ হাওয়েলস ছিলেন শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যক্ষ। পরবর্তী জীবনে ধর্মমতি প্রিয়নাথকে দেখা গেছে ডাঃ হাওয়েলসের কথা বলতে গিয়ে বারে বারে উচ্ছসিত হয়ে উঠতে। ডাঃ হাওয়েলসও চিনে নিয়েছিলেন প্রিয়নাথকে- প্রিয়নাথের ভিতরকার সাগরনোম্মুখ প্রভূত সম্ভাবনাকে। প্রিয়নাথের ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার সমাপ্তিতে কলেজ থেকে বিদায় গ্রহণকালীন যে প্রসংশা পত্র ডাঃ হাওয়েলস দিয়েছিলেন তা অনবদ্য ও অসাধারণ। তাতে তিনি প্রিয়নাথের ধর্মজ্ঞান ও উচ্চ আধ্যাত্মিক জীবনের ভূয়শী প্রসংমা করেন এবং এর ফলে প্রিয়নাথ সেযুগের ব্যাপ্টিষ্ট মিশনারী সোসাইটির হোম মিশনারীর পদ গ্রহণে অনুরুদ্ধ হন। হোম মিশনারীদের দুইটি গ্রেড ছিল, একটি ইউরোপীয়, অপরটি ভারতীয়। ভারতীয়দের মধ্যে যাদের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যেত, তাঁদের মধ্যে থেকে বেছে অল্পসংখ্যক দু-একজনকে দেওয়া হত ইউরোপীয় গ্রেড। ইউরোপীয় গ্রেড প্রতিষ্ঠিত মিশনারীদের সম্মান ও অন্যান্য সুবিধা ছিল অনেক বেশি। বলাবাহুল্য প্রিয়নাথকে ইউরোপীয় গ্রেড দেওয়া হল।
    ১৯১৭ সালে মিশনকর্ম গ্রহণ করে প্রিয়নাথ প্রথমে নিজ দেশ বরিশালে, পরে যথাক্রমে খুলনায়, কলকাতায়, কটকে ও শ্রীরামপুরে বদলী হন। এসব স্থানে তিনি তাঁর কর্মক্ষমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সে যুগের বহু মানুষের কাছে শোনা গেছে, যখন প্রিয়নাথ উপাসনালয়ের বেদীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হতেন, তখন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ সেই পবিত্র মুখ শ্রীমণ্ডিত পুরুষ প্রার্থনায় শাস্ত্র ব্যাখ্যায়, সংগীত-মাধুর্যে ও অনন্যসাধারণ বাগ্মীতায় উপাসনালয়স্থিত সমস্ত মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলতেন। বহুক্ষেত্রে তাঁরা স্পষ্ট অনুভব করতেন উপসনালয়ে পবিত্র আত্মার পূর্ণ উপস্থিতি।
    কলকাতায় থাকাকালে ১৯২২ সালে প্রিয়নাথ ইচ্ছাময়ী মাহান্তি নামে এক বিদূষী মহিলার পাণিগ্রহণ করেন। ইচ্ছাময়ী তকন ইন্টালী মিশন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার জন্য ব্যাপ্টিষ্ট মিশনারী সোসাইটি তাঁকে হোম মিশনারীর পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বিবাহের অব্যবহিত পূর্বে সেই পদ গ্রহণ করেন, কিন্তু বিবাহের পরে প্রিয়নাথ চান যে স্ত্রী স্বাধীনভাবে অন্য কোন কর্ম না করে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার কাজে সহায়তা করেন। সেই কারণে ইচ্ছাময়ী বিবাহের পরই মিশনারী পদ ত্যাগ করেন।
    সেদিন প্রিয়নাথের চরিত্রের যে দৃঢ়তা যে আত্মসম্মানবোধ, যে তেঁজ ও নির্ভীকতা প্রকাশ পেয়েছিলে তার দৃষ্টান্ত বিরল। চাকুরী ত্যাগের পরে ১৯২৫ সালে বরিশালে তার স্বগ্রাম পৈত্রিক ভিটায় চলে আসেন। তখন তাঁর দুই কন্যা জন্ম গ্রহণ করেছে…. বৃদ্ধা মাতা জীবিত আছেন। এমন অবস্থায় পরমপিতা সুযোগ জুটিয়ে দেন, প্রভুর নাম প্রচারের কর্ম গ্রহণ করে প্রিয়নাথ সুদূর রাজস্থানে গমন করেন।
    রাজস্থানে ঘোড়ায় চরে তাঁকে দূরদূরান্তে ভ্রমণ করতে হত। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর পেটের পীড়া দেখা দিয়েছিল। পুরনো সেই ব্যধি রাজস্থানে আসার পরে ক্রমাগত বাড়তে থাকে…. কিছুতেই তার উপশম হয় না। চিকিৎসক বলেন যে রাজস্থানের আবহাওয়া তাঁর দেহ ঠিক সহ্য করতে পারছে না… স্থান পরিবর্তনই নিরাময় হবার একমাত্র উপায়। অবশ্য ঈশ্বরের ইচ্ছাও বোধ হয় তাই ছিল। কারণ যাঁকে সমগ্র পূর্ববঙ্গের সেবা করার জন্য ঈশ্বর নিযুক্ত করেছেন, তাঁর রাজস্থানে পড়ে থাকলে চলবে কি করে? কাজেই কিছুদিন পরে তিনি ফিরে আসেন তাঁর বাল্যভূমি ইন্দুরকানি গ্রামে। এই গ্রামেরই কাছেই এক গ্রাম গৌরনদী, গৌরনদীতে রোমান ক্যাথলিক সাহেবদের মস্তবড় কুঠি। কুঠির সাহেব তখন বাইবেল ও বাইবেল বিষয়ক বিভিন্ন পুস্তক অনুবাদ করার জন্য উপযুক্ত লোক খুঁজছেন।
    প্রিয়নাথের সাহিত্য প্রতিভা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখার সুললিত ভাষা, উচ্চ চিন্তাধারার অনবদ্য প্রকাশভঙ্গী জনহৃদয় জয় করেছিল। সে যুগের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ছিল তাঁর লেখা গল্প কবিতা প্রবন্ধাদিতে পরিপূর্ণ।
    প্রিয়নাথকে সাহেব সাগ্রহে গ্রহণ করলেন অনুবাদের কাজের জন্য। কুঠিতে বসে প্রিয়নাথ কাজ করতেন… অবসর সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রার্থনা করতেন। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের সঙ্গে সমানভাবে মিশে তাদের কাছে ঈশ্বরের নাম বিলিয়ে তিনি অপূর্ব আনন্দ পেতেন। সেবক সংগীতের বেশিরভাগ গানই তিনি এখানে বসে রচনা করেন এবং ছাত্রদের শিক্ষা দেন। এখানে রোমান ক্যাথলিকদের যে বিদ্যালয় ছিল সে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতেন, বিকালে তাদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতেন এবং সন্ধ্যার পরে বসে তাঁর নতুন রচিত গান তাদের শেখাতেন। সেসব গান তাদের হৃদয় স্পর্শ করে এবং দিনে দিনে তা খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
    অবসর সময়ে প্রিয়নাথ বিভিন্ন স্থানে সভা প্রার্থনা আরম্ভ করলেন। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি কোন না কোন বাড়িতে গান, প্রার্থনা, শাস্ত্রপাঠ ও শাস্ত্রব্যাখ্যায় সকলকে উদ্দীপিত করে তুলতে লাগলেন। এসমস্ত বিষয়ে ঈশ্বর প্রদত্ত এক অনন্য সাধারণ শক্তি তাঁর মধ্যে ছিল। মানুষ দলে দলে সে সমস্ত সভায় যোগ দিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রত্যক্ষ করতে লাগল। প্রিয়নাথ শনিবারে গৌরনদী থেকে স্বগ্রাম ইন্দুরকানীতে চলে আসতেন এবং নিজ বাড়িতে অথবা অপর কোন বাড়িতে অনুরাগী ভক্তগণের সঙ্গে সমবেত হতেন। বরিশাল ও ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চলে তখন পাগলা সমিতি নামে একটি সংস্থা কার্যকরী ছিল। তাঁরা পাগল অর্থাৎ ঈশ্বরের নামে তাঁরা উন্মত্ত। তাঁরা কোন স্থানে সমবেত হবেন এবং পিতা ঈশ্বরের প্রসংসায় ও প্রেমে গদ গত হয়ে সংগীতে, নৃত্যে, প্রার্থনায় ও চোখের জলে, আত্মনিবেদনের আকুতিতে চরমভাবে মেতে উঠতেন। বাইরে থেকে লোকে দেখে তাঁদের বলত পাগল এবং তাঁরা আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করতেন যে তাঁরা সত্যিই পাগল- প্রভুর নামে পাগল।
    প্রিয়নাথ বুঝলেন যে প্রভুর নামে আত্মভোলা এসব মানুষ সেই স্বাদ পেয়েছেন যা পেলে মানুষের অন্য কিছু আস্বাদন করার আকাঙ্খা চলে যায়, “খ্রীষ্ট বলেছেন, আমি যে জল দিব তাহা যে কেহ পান করে, তাহার পিপাসা আর কখনও হইবে না, তাহা তাহার অন্তরে এমন জলের উনুই হইবে, যাহা অনন্ত জীবন পর্যন্ত উথলিয়া উঠিবে”।
    প্রিয়নাথ এঁদের সহভাগিতায় প্রবেশ করলেন। দেখতে দেখতে পাগলা সমিতি এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করল। প্রিয়নাথের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাব এবং সুষ্ঠু নেতৃত্বের ফলে লোকেরা দলে দলে এই উদ্দীপনা সভায় যোগ দিয়ে অনুতাপের ক্রন্দনে পাপস্বীকারের ব্যাকুলতায় আপন আত্মাকে শুচি ও পরিস্কৃত করে এক অনাস্বাদিতপূর্ব মধুময় জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে লাগল। কত কঠিন রোগ-মানসিক কত অশান্তি, কত দুর্বলতা, ভয়, উৎকণ্ঠা, জীবন ধারনের দৈনন্দিন গ্লানি মুহূর্তে দূর হয়ে গিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করল বিমল আনন্দ, গভীর শান্তি ও অপার তৃপ্তি। মানুষ পাগল হয়ে উঠল। কোথায় ছিল এ শান্তি- এ আনন্দ- এ পরিতৃপ্তি! সারা জীবন তারা আকুল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে যে সুখের আশায়- সে সুখ যে এখানে এমনভাবে লুকিয়ে আছে তাকি কখনো তারা বুঝতে পেরেছিল? আজ একি হল! শূণ্য হৃদয় পূর্ণতায় এমন করে ভরে উঠে আনন্দের যে বিপুল বেগ সৃষ্টি করল, একটুকু দেহে সে বেগ ধারণ ক্ষমতা কোথায়? তাদের সারা অন্তর দুলিয়ে দিয়ে বাঁধনহারা প্রাণ উচ্ছলিত আবেগে গেয়ে উঠল
    “বহে উজানে আজ জীবন নদীর জল।
    তোরা জয় যীশু জয় বল,
    সৃষ্টি হয়েছে চঞ্চল
    ঐ দেখ নেচে উঠল ধরাতল।”
    মানুষ বুঝল, তাকে সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে তার জীবনকে চিরানন্দ বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পবিত্র আত্মা স্বয়ং নেমে এসেছেন এই উদ্দীপনাময়ী সহভাগিতার উপরে।
    প্রিয়নাথের নেতৃত্বে সেবক সমিতি নতুন প্রাণ পেয়ে নব কলেবর ধারণ করে অতি দ্রুত পূর্ববঙ্গকে মাতিয়ে তুলল। দেশ দেশান্তর-থেকে খ্রীষ্টান, হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে এই সভায় যোগ দিতে লাগল। প্রিয়নাথের প্রাণ মাতানো গান যখন সমস্ত লোকো একযোগে প্রাণঢালা সুরে গেয়ে উঠত, তখন এমন পাষাণ প্রাণ কেউ থাকত না যার চোখে জল দেখা না দিত।উচ্ছ্বসিত হৃদয়ের উদত্ত প্রার্থনা যখন সমবেতভাবে নিবেদন করা হত তখন এক অবর্ণনীয় ব্যাপার ঘটত। প্রতিটি প্রাণী মুহুর্মূহু রোমাঞ্চিত ও কম্পিত হয়ে উঠত এবং তাঁদের রক্তে লাগত এক অনির্বাচনীয় দোলা। শীতের রাতেও দেখা যেত তাঁদের দেহ ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। সে এক বর্ণনাতীত অনুভূতি।
    সেবক সমিতির এক একটি সভা চার, পাঁচ, ছয়দিন পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলত। শত শত লোক হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীষ্টান প্রভুর নামে, সেবক সমিতির নামে মানত করত এবং সে মানতের ফল হাতে হাতে পেয়ে পরের সভায় তারা সাক্ষ্য দিয়ে সেই মানতদান উৎসর্গ করত। এক একটি সভায় কেবল মানত দান উঠত শত শত টাকা।
    সে সমস্ত সভার অমর এবং গৌরবান্বিত স্মৃতি নিয়ে আজও বহু বৃদ্ধ পূর্ব বঙ্গে জীবিত আছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের একমাত্র সম্বল সেই মহামতির অমূল্য স্মৃতি এবং তার থেকে সংগৃহীত পরম আশীর্বাদের অমূল্য পাথেয়।
    প্রিয়নাথ তাঁর সেবকদলসহ প্রায়শই বের হয়ে পড়তেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মণ্ডলরি পর মণ্ডলী গান প্রার্থনা ও শাস্ত্রালোচনার অমোঘ মন্ত্রে প্লাবিত করে অগ্রসর হতেন। দলে দলে নর-নারী তাঁকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেত। সমগ্র দল বহু জনপদ মুখরিত করে ভক্তির বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত দেশের পর দেশ গ্রামের পর গ্রাম।
    বর্ষার সময় যখন সারা দেশ জলমগ্ন, তখন বড় বড় নৌকা ভাড়া করে সেবকের দল বের হয়ে পড়তেন েএবং মাসের পর মাস তাঁদের চলত প্রতীপ্ত পরিক্রমা- গৌরবময় বিজয় অভিযান। সেবক সমিতির ও প্রিয়বাবুর জয়ধ্বনিতে ছেয়ে গেল পূর্ববেঙ্গের আকাশ বাতাস।
    খাঁটি ভারতীয় ধারায় ভক্তির প্লাবনে প্রবাহিত এই উপসনা পদ্ধতি অনেক মিশনারী সাহেবের মনঃপুত হল না। তাঁরা দেখলেন, তাঁদের সমস্ত কর্তৃত্ব হাত ফসকে চলে গেছে এমন একজনের হাতে, যিনি সাহেবদের সাহেবী বাংলায় রচিত প্রাণহীন সংগীত ও নির্জীব উপাসনা পদ্ধতির ধার ধারেন না। বরিশাল, ফরিদপুরের অন্তত বিশ পঁচিশ হাজার খ্রীষ্টান মন্ত্রমুগ্ধের মতই মধু মেলাতে মক্ষিকার মত তাঁরই পশ্চাতে ফিরছে সাহেবদের শত অনুনয়ে কর্ণপাত না করে। জ্বালাময় গাত্রদাহে সহেব এবং তাঁদের অনুগত কর্মচারীবৃন্দ যত বাঁধা দিতে লাগলেন ততই নিজেদের দেখতে পেলেন অধিকতর অসহায়রূপে। অনেকে প্রতিরোধ করতে এসে নিজেরাই কোন এক অজ্ঞান শক্তিতে বশীভূত হয়ে প্রিয়নাথের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন সানন্দে।
    অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, লোকে প্রিয়নাথের রচিত গান ছাড়া অন্য গান গায় না। নিতান্ত অজ্ঞ চাষীশ্রেণীর লোক, যাদের মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের হত না, তারাও প্রিয়নাথের সহচর্যে থেকে এমন ভাব ও ভাষায় প্রার্থনা করতে শিখল যে, অনেক বড় বড় শিক্ষিত লোকও তা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। প্রতি সন্ধ্যায় প্রায় প্রতি গৃহে সেবক সংগীতের (প্রিয়নাথ রচিত সংগীত পুস্তক) গান, খোল, করতালসহযোগে বিশেষ উৎসাহ সহকারে গীত হতে লাগল।
    এর মধ্যে প্রিয়নাথের কর্মধারা ও কর্মস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। প্রিয়নাথ যখন গৌরনদীতে অনুবাদের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তখন বরিশালের ব্যাপ্টিষ্ট মিশনের মিশনারী রেভাঃ এইচ, এম, অ্যাঙ্গাসকে প্রায়শই টরকী বন্দরে যেতে হত। যে পথ দিয়ে সাহেব যেতেন সেই পথের উপরেই গৌরনদী। যাবার সময় এবং আসবার সময়েও অ্যাঙ্গাস সাহেব নিয়মিত প্রিয়নাথের কাছে যেতেন এবং বারে বারে সনির্বদ্ধ অনুরোধ জানাতেন, প্রিয়বাবু প্রতিবারেই তা প্রত্যাখ্যান করতেন। জানতেন একদিন যে কাজ তিনি ছেড়ে এসেছেন, সে কাজে পূর্ণবহাল হবার আর তাঁর ইচ্ছা নেই। এইভাবে পুরো দুই বছর কাটে। অ্যাঙ্গাস সাহেব কোনমতেই আশা ছাড়েন না। অবশেষে ১৯৩৫ সালে বঙ্গীয় ব্যাপ্টিষ্ট সংঘ নামে এক নতুন মিশন সংস্থা গড়ে ওঠে প্রাতঃস্মরণীয় যতীন্দ্র কুমার বিশ্বাসের সভাপতিত্বে। এই সংস্থার সংবিধানানুযায়ী মিশনের কর্তৃত্ব অনেকাংশে চলে আসে ভারতীয়দের হাতে। অ্যাঙ্গাস সাহেবের দীর্ঘদিনের অনুনয়ে এবং আরও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরোধে প্রিয়নাথ বঙ্গীয় ব্যাপ্টিষ্ট সংঘের মিশনারী হিসাবে মিশনের কার্যভার গ্রহণ করেন। এটা ১৯৩৫ সালের কথা।
    মিশনের কাজে ঢুকে তিনি সেবক সমিতির কাজ করার প্রচুর অবসর পেয়ে গেলেন এবং সে সুযোগ পূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করতে করতে তিনি এগিয়ে গেলেন দ্রুত গতিতে।
    মিশন কর্তৃপক্ষ- রক্ষণশীলেরা প্রমাদ শুণলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন মিশনের কাজ দিয়ে তাঁকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারবেন, কিন্তু তাঁদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল। অবশেষে তাঁরা স্থির করলেন প্রিয়নাথকে অনেক দূরে কোন মিশন কেন্দ্রে বদলী করে বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে সরাতে। সেই অনুযায়ী তাঁকে ঢাকায় বদলী করা হয় এবং তিনি ১৯৩৮ সালের অগ্রহায়ন মাসে ঢাকায় চলে আসেন। সেদিন সমগ্র বরিশাল ফরিদপুরের লোকে বিশেষ করে শত শত সেবকেরা অঝোর ধারে কেঁদেছিলেন পিতৃবিয়োগ ব্যথাতুর সন্তানের ন্যায়। প্রিয়নাথ তাদের শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ঈশ্বরে মতি স্থির রেখে এই উদ্দীপনার ধারা বজায় রাখতে। তিনি চলে আসার পরে তাঁর সুযোগ্য দক্ষিণহস্ত সেবকদের অগ্রগণ্য ভক্তপ্রবার রূবেন সরকার তাঁদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সেবক সমিতির বিজয় যাত্রা চালিয়েছিলেন বহুদিন পর্যন্ত।
    ঢাকায় গিয়ে প্রিয়নাথ মফঃস্বল অঞ্চলেই বেশী ঘুরতেন। সেখানে ধার্মিকতার জন্য তৃষিত কিছু নারী পুরুষের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন, যাদের নিয়ে প্রার্থনায় বসে অপার শান্তি পেতেন এবং তাঁদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। ঢাকায় থাকাকালীন তিনি বেশ কিছু সংক্ষক গান রচনা করেন। আজ যে কলকাতা, ঢাকা প্রভৃতির বেতার কেন্দ্রে বড়দন, নতুন বছর কিংবা পূণ্যশুক্রবার উপলক্ষ্যে খ্রীষ্টিয় সংগীত, গীতি-আলেখ্য অথবা নাটিকা পরিবেশন করা হয়, প্রিয়নাথই এর প্রথম উদ্যোক্তা। ঢাকায় থাকাকালীন তিনি কয়েকবার এসব উপলক্ষ্যে বেতার অনুষ্ঠান করেন।
    ঢাকাতে পাঁচ বছর কাটাবার পরে প্রিয়নাথকে বদলী করা হয় চব্বিশ পরগণার ক্যানিং টাউনে। ক্যানিং- এর নোনা জল, হাওয়া তাঁর স্বাস্থ্যের অনুকূল না হওয়ায় তিনি প্রায়শই পেটের অসুখে কষ্ট পেতে থাকেন। এরপরে তাঁকে শেষ বারের মত বদল িহতে হয় শ্রীরামপুরে। তাঁর অসাধারণ সাহিত্যে প্রতিভার স্বীকৃতস্বরূপ মিশন কর্তৃপক্ষ তাঁকে খ্রীষ্টিয় সাহিত্য বিষয়ক কর্মে নিয়োজিত করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের পৌষমাসে অবসর গ্রহণ করেন।
    প্রিয়নাথের এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হল বাংলা ভাষায় যীশু খ্রীষ্টের সুবৃহৎ জীবনী প্রণয়ন। প্রিয়নাথ দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষায় যীশুর সুবৃহৎ প্রামান্য জীবনীর অভাব অনুভব করেছিলেন। রোমান ক্যালিক সাহেব ফাদার ফাঁলো মথি, মার্ক, লুক ও যোহন লিখিত সুসমাচার একত্রে সন্নিবেশ করে যীশু খ্রীষ্টের জীবনী না দিয়ে একটি পুস্তক বের করেছেন, কিন্তু ইংরেজী ভাষায় বৃহৎ জীবনীর সঙ্গে তুলনীয় খ্রীষ্ট জীবনী আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বের হয়নি।প্রিয়নাথ শ্রীরামপুরে এসে এই কাজে অতি নিষ্ঠাসহকারে হাত দিলেন।
    প্রায় তিন বছরের কাঠোর পরিশ্রমে তিনি এ কার্য সম্পূর্ণ করেন। এই পাণ্ডুলিপি যে সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পাঠ করেছেন তাঁরা স্বীকার করেছেন যে এ পুস্তক ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষায় রচিত যীশুর বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থের সঙ্গে নিঃসন্দেহে তুলনীয় এবং সেসবের সঙ্গে একই শ্রেণীতে স্থান পাবার যোগ্যতা রাখে।
    এছাড়া এই সময়ে প্রিয়নাথ অবকাশরঞ্জন না দিয়ে একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। এই পুস্তকে তাঁর রচিত বহু কবিতা, গল্প, রস-রচনা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
    প্রিয়নাথ সারা জীবনে বহু লিখেছেন, কত বই যে ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তার সীমাসংখ্যা নেই। এছাড়া তাঁর নিজের রচিত নাটক, বাক্যও কিছু আছে। তিনি মুখে মুখে যে কোন বিষয়ে কবিতা রচনা করে বলে যেতে পারতেন- তাঁকে একটুও ভাবতে হবে না। বহুপূর্বে তিনি পূর্ববংগে খ্রীষ্টানদের ‘কবিগানের’ দল বের করেন এবং বহু ঘটনার উপরে ভিত্তি করে বহু গান রচনা করে দাদের দ্বারা গাওয়াতেন। কবি গানে শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন শ্রীনাথ রায় ও তাঁর পুত্র হলধর রায়। সেরূপ মধুময় কণ্ঠ গরে গ্রামের কোথায় শোনা যায় না।প্রিয়নাথের রচিত সে সমস্ত গানও উচ্চ সাহিত্যেক মূল্য পাবার অধিকারী। তাঁর সমস্ত রচনা সংগ্রহের প্রচিষ্টা চলছে।
    চাকরী জীবন থেকে অবসর নেবার পর তিনি স্বপরিবারে শ্রীরামপুরেই বাস করতে থাকেন। এসময় বৃদ্ধবয়সজনিত নানা শারিরীক উপসর্গ তাঁকে প্রায়শই কষ্ট দিত। এসব সত্বেও তিনি পূর্ববঙ্গকে ভুলে থাকতে পারেননি। ১৯৪৯ সালের প্রথম থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৭ সালে ডিসেম্বর মাসে পরলোকগমন করেন। এই দীর্ঘ নয় বছরের মধ্যে বহুবার তিনি পূর্ববঙ্গে গেছেন এবং এক একবারে ক্রমান্বয়ে তিনি চার পাঁচ মাস পর্যন্ত কাটিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন পরিবার, বিভিন্ন মন্ডলী তাঁকে জিনগৃহে বা মন্ডলীতে পাবার জন্য সর্বদা লালায়িত থাকত।বহুলোক তাঁর সঙ্গে ঘুরত, সপরিষদ তিনি যে গৃহে গিয়ে উঠতেন, বহু নরনারী সেই গৃহে ছুটে আসত তাঁকে দেখবার জন্য। তাঁর উপস্থিতিতে গৃহে গৃহে মন্ডলী ও মন্ডলীতে আবার আনন্দের রোল উঠত, জীবনের আশা আনন্দ আবার ফিরে আসে, নতুন করে তাদের মন আবার প্রভুর পায়ে আত্মসমর্পনের আকুতিতে বিহ্বল হয়ে উঠত। এমনই ছিল প্রিয়নাথের প্রিয় সাহায্যের প্রেরণা।
    শেষ জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি নির্জনে কাটাতেন। তবুও বহুলোক শ্রীরামপুরের বাড়িতে তাঁর কাছে আসত। বহু মন্ডলী অতি আগ্রহসহকারী তাঁকে আমন্ত্রণ জানাত কোন বিশেষ উপসনা পরিচালনা করার জন্য। কলকাতা ইত্যাদি অঞ্চলে তাঁর সুনাম এবং বহু সুখ্যাতি ছিল। বিশেষ করে তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতার পরিচয় যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা ভুলতে পারেননি। কি অনবদ্য ছিল তাঁর চিন্তাধারা, বিষয়বস্তুর প্রকাশভঙ্গী এবং ভাষার উপরে দখল। তাঁর কথার মধ্যে যে দরদ, যে বেদনা প্রচ্ছন্ন থাকত তা মানুষের অন্তরের অন্তস্থলকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ফিরত। অতি গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তাধারা, অতি কঠিন ও উচ্চভাবসমূহ তিনি স্বরল ও দরদী ভাষায়, আবেগের সঙ্গে এমন সর্বজনবোধ্য ও চিত্তাকর্ষক করে পরিবেশন করতে পারতেন যে মানুষ বিষ্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেত এবং তাদের মন গভীরভাবে আলোড়িত হত। বহুস্থানে প্রদত্ত তাঁর অনেক বক্তৃতা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মূল্যায়নের মানদণ্ডে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য।
    সঙ্গীতেও প্রিয়নাথ ছিলেন অন্তস্পর্শী কণ্ঠস্বরের অধিকারী একাধারে তিনি ছিলেন সঙ্গীত রচয়িতা, সুশিল্পী এবং গায়ক। লোকে তাঁর অনবদ্য কণ্ঠ ধ্বনির খুবই উচ্চ প্রশংসা করত, কিন্তু তবু তারা ঠিক জানত না কি বিষ্ময়কর উচ্চ স্তরের সে কণ্ঠস্বর। সে কথা বোঝা গেল সেদিন, যে দিন সুবিখ্যাত সুরশিল্পী ও ওস্তাদ সুধীরলাল চক্রবর্তী ঢাকায় বসে প্রথম শুনলেন প্রিয়নাথের গান। তখন প্রিয়নাথের বয়স প্রায় পঞ্চান্ন বছর বহু বৎসর যাবৎ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। সুধীরলালের অনুরোধে তিনি তাঁর ছাত্রজীবনে শেখা একটি ধ্রূপদাঙ্গের গান গেয়েছিলেন। গান শেষ হলে অভিভূত সুধীরলাল ঠিক এই কথাই বলেছিলেন যে, সারা ভারতবর্ষ তিনি ঘুরেছেন- ভারতের সেরা গায়কদের গান তিনি শুনেছেন। গায়কি তাঁদের অতি উচ্চাঙ্গের, পাণ্ডিত্যও অগাধ, কিন্তু এমন কণ্ঠমাধুর্যের অধিকারী তাঁরা কেউই নন, এমন উচ্চাঙ্গের কণ্ঠস্বর তিনি শোনেননি।
    এত বড় কথা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। প্রিয়নাথের জেষ্ঠ পুত্র নলিনী এমন কথা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। সুধীরলালের সঙ্গে পরে তার আলোচনা হয়েছে। সুধীরলাল ঠিক এই কথা বলেছেন, “নলিনী। তুমি জান না েএত অপরূপ কণ্ঠমাধূর্য নিয়ে যদি কেবল সংগীত নিয়ে সাধনা করতেন, তবে ভারতের অন্যতম সেরা গায়ক হতে পারনে।”
    প্রিয়নাথের রচিত সংগীত অনেক বড় বড় সাহিত্যিকের স্বীকৃতি পেয়েছে, একবার প্রিয়নাথেরই একজন ভক্ত, শান্তি নিকেতন তপোবন বিদ্যালয়ের শিক্ষক বীরেন বাবু একখানি সেবক সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার অর্ঘ্যস্বরূপ দেন এবং বলেন যে, তাঁরই গুরুস্থানীয় এক ব্যক্তির রচিত সে সংগীতমালা। রবীন্দ্রনাথ গানগুলি দেখেন এবং উচ্চ প্রসংসা করে বলেন যে, ভক্তপ্রাণের চরম আত্মনিবেদনের সুর সহজভাব ও ভাষার মধ্য দিয়ে যেভাবে গানগুলির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তেমন প্রকাশভঙ্গী দেখা যায় না।
    যথাযসময়ে একথা প্রিয়নাথের কের্ণগোচর হয় এবং তিনি কেঁপে ওঠেন। আবেগমণ্ডিত স্বরে অভিভূতের মত তিনি বার বার বলেন, “এ বই তিনি স্পর্শ করেছেন, গানগুলি তাঁর ভাল লেগেছে, একথা আমি ভাবতে পরি না- ভাবতে পারি না!”
    একথা এখানে উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, প্রিয়নাথের মত রবীন্দ্রনাথের অতবড় ভক্ত বোধ হয় খুব কমই ছিল, রবীন্দ্রনাথের কথা আলোচনা করতে গিয়ে সংযতবাক প্রিয়নাথ আত্মহারা হয়ে পড়তেন, তাঁর চোখমুখের ভাব অন্যরকম হয়ে যেত। শুনবার মত ছিল তাঁর রবীন্দ্র কাব্য-সাহিত্য আলোচনা, অনুভূতির তীব্রতায় যেন তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন।
    আজ পশ্চিম বাংলার শহরাঞ্চলেও এ গান ছড়িয়ে পড়েছে। যে সব গান পূর্ব বাংলার মেঠোসুর বাঁধা- সে সুর- সেগ্রাম্য টান ঠিক শহরবাসীর গলায় আসে না, কিন্তু যে গানগুলি শুদ্ধরাগের উপরে প্রতিষ্ঠিত সেসব গান শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ভক্তদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
    মৃত্যুর পূর্বে প্রিয়নাথ সহধর্মিনীকে বলেছিলেন, “আমি সারা জীবনে টাকা পয়সা কিছু সঞ্চয় করিনি। পুত্র কন্যাদের দিয়ে যাবার মত আমার পার্থিব সম্পদ কিছু নেই। কেবল তাদের জীবনে আমার এই উইল রইল যেন তারা ঈশ্বরের সমর্পিত প্রার্থনাশীল জীবন যাপন করে। আমি তাঁর (ঈশ্বরের) উপর নির্ভর করে যে ধন পেয়েছি সমগ্র জগতের ঐশ্বর্য তার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ। তারা যেন সেই অপার্থিব ধনের অধিকারী হয় জীবনে- আমার এই অন্তিম ইচ্ছা রেখে গেলাম তাদের জন্য।”
    শেষের দিনগুলিতে তাঁর অন্তরে এই গানই বারে বারে ধ্বনিত হয়ে উঠছে-
    “বসে আছি সেই দিনের আশায়
    দয়াল যে দিন তুমি ডাকবে আমায়
    ওপার হতে আসবে তরণী।
    ছেড়ে অসার সংসার যাব ওপার
    যথা, তোমার রাজধানী।”
    অবশেষে ১৯৫৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ভোররাত আন্দাজ ৩টায় যে আকাঙ্খিত দিনের আশায় তিনি বিসেছিলেন- সে মহাদিন এগিয়ে এল এবং তাঁর প্রিয়তমের প্রেরিত তরণী বেয়ে সেই রাজধানীর উদ্দেশ্যে তিনি মহাপ্রয়াণ করলেন। উপযুক্ত মর্যাদায় তাঁর দেহ সমাহিত করা হল শ্রীরামপুর জন নগর সমাধিক্ষেত্রে। সমাধি অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করলেন শ্রীরামপুর কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ ডাঃ সি, ই, আব্রাহাম। বহু প্রতিভার এই খ্রীষ্টভক্ত তার সারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন প্রভু যীশুর পায়ে। খ্রীষ্টের নাম বিস্তারে িএবং মহিমা কর্তনে তার উপরে দত্ত প্রাণ বর হিসেবে সংগীতকে গণ্য করা যায়। আর েএই বর সম্বন্ধে তিনি বারবারই সজাগ ছিলেন। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তিনি তা ব্যবহার করেছেন। ঈশ্বরও তাকে আরো বেশী করে সেই বর ঢেলে দিলেন। যেমন মথি ১৩ অধ্যায়ের ১২ পদে প্রভু বলেছেন ‘কেননা যাহার আছে তাহাকে দেওয়া যাইবে ও তাহার বাহুল্য হইবে; কিন্তু যাহার নাই তাহার যাহা আছে, তাহাও তাহার নিকট হইতে লওয়া যাইবে।’ তাঁর সঙ্গীত রচনার যে ক্ষমতা, ভাব প্রকাশের যে শক্তি, অন্তরের ভাবকে বাইরে টেনে এনে তা অন্যের সামনে একেবারে জীবন্ত কায়ায় দাঁড় করতে পারার যে ক্ষমতা তা এক কথায় অসাধারণ, অতুলণীয়। প্রিয়বাবুর গান না হলে খ্রীষ্ট ভক্তের যে প্রাণ ভরে না। গান যদি প্রাণ ছুঁতে না পারে তবে তা প্রাণহীন হয়। আর অন্যের প্রাণ ছুতে হলে সে গান আসতে হবে রচয়িতার অন্তর থেকে, মাথা থেকে নয়।
    ঈশ্বরের দাস প্রিয়নাথ শুধু সংগীত সাধনার মাধ্যমেই তার প্রভুর সেবা করে গেছেন তাই নয়- তার জীবনের সম্পূর্ণ অংশই তিনি খ্রীষ্টের পায়ে নিবেদন করেছিলেন। তার নিজের জন্য কিছু রাখেন নি। তার জীবনে ছিল ত্যাগস্বীকার, ছিল ধৈর্য্য, ছিল পরিশ্রম। কিন্তু সবই প্রভুর জন্য। কোন মায়া-মোহ, লোভ, চাওয়া-পাওয়ায় তাকে বাঁধতে পারেনি। তিনি সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে বার বার প্রভুর চরণে লুটিয়ে পড়েছেন। একমাত্র সাধনা যে ছিল ‘খ্রীষ্টের চরণসেবায় তা তার সঙ্গীতের সর্বত্রই ফুটে উঠেছে। (সংক্ষিপ্তি ও পরিমার্জিত)
    সূত্রঃ প্রকাশক বাবু উলিয়াম ঢালীর প্রকাশিত সেবক সঙ্গীত প্রথম সংস্করণ থেকে সংগৃহিত।

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS