বড়দিন কেবল এক দিন নয়, যদি মন বড় হয়

ads20
    বড়দিনের এক চিরন্তন আহ্বান আছে। তা আমাদের মনকে বড় করার আহ্বান! বড়দিন ফিরে আসে আমাদের মধ্যে ঐশ-অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে, যেন আমরা মানুষের সেবা ও মঙ্গলের জন্য খ্রিস্টের আদর্শে অনুপ্রাণিত হই। বড়দিনের আহ্বান মনকে বড় করার আহ্বান আর তা কেবল বছরে এক দিনের জন্যই নয়।
    ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয়ের মাস। প্রায় ৯ মাস এ দেশে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা সীমাহীন অত্যাচার ও নিধনযজ্ঞ চালানো শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর হাতে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের দিন এগিয়ে আসছিল, তখন বারবার তাদের ওপর মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে উর্দু ভাষায় এই নির্দেশটি প্রচার করা হয়েছিল, 'হাতিয়ার ডাল দো' অর্থাৎ 'তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ করো।' অবশেষে এলো ১৬ ডিসেম্বর। ওই দিন সব মারণাস্ত্র সমর্পণ করে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। মানুষের হিংসা, অহংকার ও লোভের হাতিয়ারগুলো খ্রিস্টের পায়ের কাছে সমর্পণের দিন বড়দিন। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে শান্তি ও কুশলের জন্য আমাদের ওই সব হীন স্বার্থপরতা ত্যাগ করে প্রেম ও ন্যায়ের আদর্শে এগিয়ে যেতে হবে। যিশু খ্রিস্টের সেই শাশ্বত আদর্শ ও শিক্ষা আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক। বড়দিন আমাদের খ্রিস্টের সুসমাচার জীবনাচরণে প্রচারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঈশ্বর চান আমরা যেন মানুষের পাপমুক্তির সুসমাচার ও তাঁর মর্মবাণী উপলব্ধি করি এবং অন্যের কাছে কথায়, আচরণে ও কাজের মাধ্যমে উপস্থাপন করি। আসিসির সাধু ফ্রান্সিস বলেছিলেন, 'সব সময়ই অন্যের কাছে সুসমাচার প্রচার করো; যখন প্রয়োজন কেবল তখন কথা ব্যবহার করো।' ফ্রান্সিস জোর দিয়েছেন জীবন ও কাজের ওপরে। তার জন্য প্রয়োজন খ্রিস্টের শিষ্য তৈরি করা।
    স্বার্থপরতা ও লোভের কারণে মানুষ নিজের ও অন্যের জন্য দুঃখের কারণ হয়; সবল ও চতুর মানুষ অন্যের অধিকার হরণ করে; সমাজে আসে বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও আঘাত। তা থেকে তৈরি হয় অশান্তি ও হিংসা। বাইবেলের অনেকাংশ জুড়েই রয়েছে ন্যায্যতার বিষয়ে সুস্পষ্ট শিক্ষা। এই ন্যায্যতা মানবসমাজ গঠনের পথে দরিদ্রের প্রতি প্রেম প্রদর্শনের বিষয়টি পুরনো ও নতুন উভয় নিয়মে বড় এক স্থান করে নিয়েছে। বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে ঈশ্বর মূল্য দেন ন্যায্যতাকে : 'ধার্মিকতা ও ন্যায়ের অনুষ্ঠান সদাপ্রভুর কাছে বলিদান অপেক্ষা গ্রাহ্য।' তিনি চান যাঁরা সমর্থ, সবল ও সক্ষম, তাঁরা যেন দুঃখী, দরিদ্র ও দুর্বলের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। খ্রিস্টধর্ম দর্শনে মানুষের জীবনের জন্য পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। মানুষ দেহে, মনে ও আত্মায় পরিপূর্ণ এবং এক সুষম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবে, তা-ই স্রষ্টা ও প্রেমময় ঈশ্বরের ইচ্ছা। বাইবেলে ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচার যেন একই অর্থ। মীখা নবীর মাধ্যমে ঈশ্বর বলেছেন, ঈশ্বর লৌকিক ধর্মকর্মে সুখী নন। বাইবেলে দরিদ্রদের প্রতি ধনী বা সবল লোকদের সেবা বা প্রেমের কাজ হচ্ছে মূলত ন্যায্যতা ও ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও নম্রতার প্রমাণ।
    আমরা ধর্মের বাণী সঠিক পালন করি না বলেই পৃথিবীর বর্তমান এই হাল হয়েছে, যেখানে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ পৃথিবীর ৯০ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে আর ৯০ শতাংশ মানুষ বাকি ১০ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে। ওই ৯০ শতাংশ মানুষের পক্ষে ঈশ্বর কথা বলেন আমাদের বিবেকে। আমাদের ঐকান্তিক কামনা ও চেষ্টা হওয়া উচিত এমন এক সমাজ ও পৃথিবী গড়া, যেখানে প্রতিটি মানুষ মানবীয় সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সুন্দর পরিবেশ ও সুযোগ পাবে, পাবে তার ন্যায্য অধিকার, হবে তার সুস্থ দেহ, মন ও অন্তর এবং সবার জীবনেই হবে স্রষ্টার প্রশংসা।
    দুই হাজার বছর আগে যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় স্বার্থপরতা ও অহংকারের কারণে গোটা মানবজাতির যে অবস্থা ছিল, তা আজও আছে। মানুষের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ তার হৃদয়ের পরিবর্তন। সর্বত্রই অশান্তি, হিংসা ও মূল্যবোধের যেন অপ্রতিরোধ্য অবক্ষয়। মানুষে মানুষে, ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল, ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাপন্ন মানুষে ভেদাভেদ দিনে দিনে আকারে-প্রকারে বেড়েই চলেছে। ঈশ্বর মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তির জন্য মানবরূপে খ্রিস্টের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রেম, ধার্মিকতা ও ন্যায্যতাকে চূড়ান্তরূপে প্রকাশ করলেন। তিনি কেবল মানুষের করুণ অবস্থাকে নিয়ে চিন্তা করেননি, ঈশ্বরবিহীন মানুষের অবস্থাকে নিজে ভোগ করলেন, কারণ তিনি তার বাস্তবতাকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত এ জগতে যিশু খ্রিস্টের আগমনের মূল ঈশ্বরতাত্ত্বিক লক্ষ্য কী, তা আমাদের আজ বোঝার দরকার আছে। কেন তিনি মানুষ হয়ে এলেন? এখানে খ্রিস্টীয় ঈশ্বরতত্ত্ববিদ হারম্যান বেভিংকের এই উক্তিটি আমার মনে আসে- 'সমস্ত সৃষ্টিই স্রষ্টা ঈশ্বরের এক প্রকাশ, তাঁর গুণাবলি ও সিদ্ধতার মুকুর; প্রত্যেক প্রাণী তার নিজ অবস্থানে ও তার নিজ উপায়ে ঐশ্বরিক অভিব্যক্তির একটা প্রতিফলন। কিন্তু সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কেবল মানুষই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, তাঁর সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ প্রকাশ; তাই সে সমস্ত সৃষ্টির মস্তক ও মুকুট।' আদি পুস্তকে আমরা দেখি ত্রিত্ব ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। নতুন নিয়মে খ্রিস্টকে বলা হয়েছে ঈশ্বরের নিখুঁত প্রতিমূর্তি, তিনি অদৃশ্য ঈশ্বরের দৃশ্যমান প্রতিমূর্তি (কলসীয় ১ : ৫)। সে কারণে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি বলতে যা বোঝায়, তা জানতে হলে আমাদের প্রথমে খ্রিস্টের দিকে তাকাতে হয়। মানুষের বুদ্ধি বা বিদ্যার বিচারে নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তার প্রেমে ও নম্রতায়। অন্য গুণাবলির সঙ্গে প্রেমই হচ্ছে ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা খ্রিস্টের মধ্যে ঈশ্বরের প্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখতে পাই। ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিমূর্তিতে নির্মাণ করেছেন। ঈশ্বরের অন্যান্য নৈতিক গুণাবলি, যেমন- পবিত্রতা, বিবেক-বুুদ্ধি, যুক্তি, ন্যায্যতা ইত্যাদির চেয়ে সবচেয়ে বড় 'প্রেম'। এই নৈতিক গুণাবলিহেতু মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। মানুষ এক আত্মিক প্রাণী।
    আমরা যখন খ্রিস্টের দিকে তাকাই, তখন আমরা ব্যক্তিসত্তাগত দুটি অদ্ভুত বিষয় তাঁর মধ্যে দেখতে পাই। একটি হলো তাঁর ঈশ্বরত্ব, অন্যটি মানবত্ব। তিনি ঈশ-মানব। একদিকে সম্পূর্ণ ঈশ্বর, অন্যদিকে সম্পূর্ণ মানুষ। তাই তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরের পরিপূর্ণ প্রকাশ দেখা যায়।
    মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের নৈতিক সাদৃশ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কারণে তাঁর আগমন।
    বড়দিন আবার ফিরে এসেছে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে খ্রিস্টের সেই আজ্ঞাকে- 'তুমি ঈশ্বরকে তোমার সর্বস্ব দিয়ে প্রেম করবে এবং অন্য মানুষকে নিজের মতোই প্রেম করবে।' মানুষকে ভালো না বেসে আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসতে পারি না!
    খ্রিস্ট ধর্ম কেবল একটা ধ্যান নয়, তা কেবল কর্মও নয়। খ্রিস্ট ধর্মের অর্থ সহভাগিতা ও অংশগ্রহণ। ধ্যানের অর্থ ঈশ্বরকে মাত্র কোনো জিনিসরূপে বা ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা, গভীরভাবে তাঁকে ভাবা; কিন্তু অংশগ্রহণের অর্থ তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও প্রেমে অন্যের জন্য এবং অন্যের সঙ্গে কাজ করা, সেবা করা, জীবনকে নির্মল আনন্দে উপভোগ করা ও অন্যকে তা ভোগ করতে দেওয়া।
    খ্রিস্টের আত্মদান ও প্রেম আমাদের সবাই আজ নতুন করে অনুপ্রেরণা দান করুক, যেন আমরাও একে অন্যকে সেবা করতে পারি। মানুষে মানুষে যদি ন্যায্যতা ও শান্তি থাকে তাহলেই স্বর্গে ঈশ্বরের গৌরব ও মহিমা হবে। অশান্ত এ পৃথিবীর মানুষ যদি যিশু খ্রিস্টের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং জীবন সম্পর্কে তাঁর পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে চেষ্টা করত, তাহলে পৃথিবীর অবস্থা কতই না সুন্দর ও শান্তিময় হতো! বড়দিন আমাদের এ আহ্বান দেয় যেন আমাদের চিন্তাচেতনা বিকশিত হয়, হৃদয় ও মন আলোকিত।
    লেখক : লেখক: রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী  ,
    অধ্যক্ষ, খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্ব মহাবিদ্যালয়, বাংলাদেশ


    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS