এক ঃ সুগভীর মাতৃভক্তি ! “হে নারী, এই সম্বোধনটি প্রায় সকলেরই কাছে অদ্ভুত ও খারাপ লাগে । খারাপ লাগাই স্বাভাবিক, কিন্তু সত্য বলতে কি, “নারী” বলে যীশু তার মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাইবেল আমাদের মাতৃভাষায় লেখা হয়নি। প্রথমে গ্রীক ভাষা পরবর্তীতে ল্যাটিন ও ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। একটি গ্রীক শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হতে পারে। এটি নির্ভর করে কখন কোন পরিবেশে সেটি ব্যবহৃত হচ্ছে। মূল গ্রীক gunai থেকে “হে নারী' শব্দটি অনুবাদ করা হয়েছে, যার অর্থ প্রথিতযশা রমণী, মা, নারী ইত্যাদি ,গ্রীক মহাকবি “হোমার' যিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা, যার জন্ম বীশুর ৮৮৪ বছর পূর্বে । তিনি তীর দ্বিতীয় মহাকাব্য ওডেসাতে বর্ণনা করেছেন, রাজা তার অতি প্রিয় স্ত্রীকে “হে নারী” (gunai) বলে সম্বোধন করতেন। রোমীয় সম্রাট আগস্টাস মিশরীয় বিশ্ব সুন্দরী ক্লিপ্ট্রাকেও gunai বলে ডাকতেন। এর থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, গ্রীক ভাষায় এ সম্বোধনটি অতি প্রিয় ও সম্মানীয়। মহিলাকেই সম্বোধন করা হতো । সুতরাং যীশু “হে নারী” বলে তীর মাকে যথাযোগ্য সম্মানই দেখিয়েছেন। পূর্বেও তিনি তার মাকে “নারী” বলে সম্বোধন করেছেন এবং মরিয়ম তার কোন প্রতিবাদ অথবা “মা” না বলার জন্য মুখ ভার করেননি (যোহন ২:8) । আবার অরামিক ভাষায় এর অর্থ -উচ্চ সম্মানিতা মহিলা । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, স্রীষ্ট অন্য স্ত্রীলোকদেরও “নারী* বলে সম্বোধন করতেন (লুক ১৩ : ১২; যোহন ২০ : ১৫) মথি ১৫ : ২৮) এবং যীশু ব্যতীত আর কেউ কখনও তা করেননি। তিনি ছিলেন মহান বিপ্লবী । সে সময় অধিকাংশ স্ত্রীলোক ছিল পুরুষের ক্রীতদাসী । তাদের প্রতি পুরুষদের অবজ্ঞা ও অত্যাচারের সীমা ছিল না। সেই সময়ে যিহুদীদের একটি বিশেষ প্রার্থনা ছিল ঃ
“হে ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে ক্রীতদাসরূপে সৃষ্টি করনি, হে ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে পরজাতিরূপে সৃষ্টি করনি এবং হে ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে 'নারীরূপে' সৃষ্টি করনি।” প্রভু স্ত্রীজীতির এ অপমান ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবের অগ্নিমশাল জ্বেলে নারীর প্রতি এক নৃতন অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেন। বিধবা, ব্যাভিচারিণী ও হতভাগিনীদের জন্য তার অন্তর ছিল দরদ ও ক্ষমায় পরিপূর্ণ। তাদের উদ্ধার ও সাহায্যের জন্য তার হাত দু'খানি ছিল সর্বদা প্রসারিত।
মা মরিয়ম যীশুর ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তবু তিনি যে মানব -কন্যা। বীশুকে আপন পুত্র ব্যতীত অন্য কিছু মনে করা মাতৃ-হৃদয়ের পক্ষে কত কঠিন। আর এ চিন্তা এত দুষ্কর বলেই না তাঁর অন্তর বিদীর্ণ হয়েছে খড়গাঘাতে। বীধ-ভাঙ্গা বন্যার মতো তীর অশ্রু ঝরে পড়েছে। কিন্তু “হে নারী" বলে যীশু তার শোকার্ত মায়ের মাথায় যেন সান্তুনার কোমল হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যেন বলছেন, “মা গো, যদিও তোমারই কোলে আমি নেমে এসেছিলাম এ পৃথিবীতে, তবু তুমি তো জানতে আমি কে। মা মরিয়ম মন্ত্রমুঞ্ধের মতো অপলক নেত্রে চেয়ে রইলেন তার ক্রুশবিদ্ধ পুত্র, ত্রাণেশ্বরের দিকে।
প্রভু যীশুর প্রচারের মূল বিষয় ছিল এশরাজ্য । যীশুর মুখ থেকে আধ্যাত্মিক জীবনের কথাই আমরা শুনতে অভ্যন্ত। কিন্তু এই বাণীর মধ্যে আছে সম্পূর্ণ জাগতিক ব্যাপারও ৷ তিনি প্রমাণ করলেন যে, পিতামাতার প্রতি জাগতিক কর্তব্যে অবহেলা করে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ করা যায় না। পৃথিবীতে অনেকেই সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেন অথচ নিজ কর্মক্ষেত্রে অবহেলা করেন এবং পিতামাতা স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিও কর্তব্য পালন করেন না। কিন্তু নিজ পরিবারকে অবহেলা করে সামাজিক দায়িত পালন করার মধ্যে যে একটা ফীকি আছে, প্রভুর এই বাণী সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
দুই ঃ “এ দেখ, তোমার মাতা!” একজন শিষ্য হলেন বিশ্বাসঘাতক, অপর একজন প্রভুকে অস্বীকার করলেন তিন বার, অন্যেরা খ্রীষ্ট যেমন পূর্বেই তাদের বলেছিলেন - “ছিন্ন-ভিন্ন হলে - অর্থাৎ প্রাণ রক্ষার জন্য আত্মগোপন করলেন (মার্ক ১৪ : ২৭)। একমাত্র শিষ্য যোহনই ক্রুশ-বেদীতলে উপস্থিত ছিলেন। এ চরম অপমান ও যাতনার মধ্যেও যীশু যোহনকে দেখে প্রাণে যে কি অপরিসীম সান্তনা লাভ করেছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। ক্রুশবিদ্ধ শ্রীষ্টের চরণতলে উপস্থিত থেকে তিনি যে শুধু তার অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নয়, কিন্ত এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন, খ্রীষ্টের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা, যার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন যে কোন মূল্য দিতে এবং তা তিনি একদিন দিয়েও ছিলেন সুসমাচারের জন্য অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে ও পাট্ম দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে (প্রকাশিত বাক্য ১ : ৯)। সুখের দিনেই শুধু নয়, কিন্তু দুঃখের দিনেও যোহন ছিলেন যীশুর কাছে। সংস্কৃতে সুন্দর একটি কথা রয়েছে -
“উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে শত্রসঙ্কটে
রাজদ্বারে শ্বশানে চ য্তিষ্ঠতি সঃ বান্ধবঃ”
অর্থাৎ,“উৎসব-আনন্দের দিনে এবং বিচার-সভায়, কিংবা মৃত্যুর সময়ে যিনি পাশে থাকেন তিনিই প্রকৃত বন্ধু।” একজন ইংরেজী লেখক প্রকৃত বন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন,
``A friend is someone who will sit with you on cold winter nights and walk with you in silence.
যোহনের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের পরিচয় যীশু আগেই
পেয়েছিলেন। তাই তিনি তাকে এত ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার পুরস্কার স্বরূপ যীশুর পার্থিব মাকেই তিনি আপন মারূপে লাভ করে কৃতার্থ হলেন। যার-তার ওপর তীর ধার্মিকা মায়ের ভার অর্পণ করা যীশুর পক্ষে সম্ভব ছিল না, খুঁজে
পেয়েছিলেন প্রিয় শিষ্য যোহনকে । বর্তমানে এই রকম মানুষের (যোহনের) বড়ই অভাব, তাই আজ যীশুর অনেক বিধবা মা নিরাশ্রয় থেকে যান। “এ দেখ, আমার মাতা বলে প্রভু সম্বোধন করেছিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনকারী মহিলাদের মেথি ১২ :৪৯)। ঈশ্বর বলেন, “আমি দয়াই চাই, বলিদান নয়” (হোসেয় ৬ : ৬)। প্রভুর মা- বোনদের, বিশেষত বিধবাদের সেবার ব্যাপারে যারা থাকে নির্বিকার, তারা পুণ্য শুক্রবারের আরাধনায় বসে অবিরত দুঃখ করেও প্রভুর প্রিয় শিষ্য বা প্রিয় মণ্ডলী হওয়ার যোগ্য হবে না। কে এগিয়ে আসবে আজ দরিদ্র ও নিরাশ্রয় বিধবাদের অশ্রুজল মুছিয়ে দিতে? স্থামীহারা-সন্তানহারাদের মুখে আবার কে ফোটাবে হাসি? এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, যোহনের মত প্রেমিক শিষ্যরাই প্রভুর জীবন ও বাণীর হন প্রকৃত প্রচারক। তার রচিত সুসমাচারটি মানব সমাজের এক অমূল্য সম্পদ।
ক্রুশের উপর যীশুর তৃতীয় বাণী এক নূতন, মহৎ সম্পর্কের কথা ঘোষণা করছে। কেবল নিজ পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনই যথেষ্ট নয়। নিজ মা ও প্রিয় শিষ্য যোহনকে এক সুত্রে গেথে যীশু এক নৃতন পরিবার গঠন করলেন। খ্রীষ্টে বিশ্বাসীবর্গ এক সুবৃহৎ পরিবারভূক্ত। এখানে একজন অন্যের দুঃখে, বিপদে, অভাবে, পীড়ায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। খ্রীষ্টের এই আদর্শ অনুসরণ করেই শ্রীষ্ট মণ্ডলী দেশে দেশে বহু হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম ইত্যাদি স্থাপন করেছে। হাজার হাজার মাতৃহারা সন্তান মাদার টেরেজার মতো মহীয়সী মহিলার মধ্যে ফিরে পেয়েছেন কল্যাণময়ী মাকে |
আজ গীর্জায় এসে আমরা দু'ফৌটা চোখের জল ফেলতে পারি। এটাই কি যথেষ্ট? প্রভু ষীশু ক্রুশের উপর থেকে আজও যেন আমাদের বলছেন, -“এ দেখ তোমার পুত্র, এ দেখ তোমার মাতা”।