অমর সপ্তবাণী
প্রথম বাণী - “পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কারণ ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না।”
লুক ২৩ : ৩৩ - ৩৪
১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি উড়িষ্যায় যে নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, তার জন্য সমগ্র ভারত, তথা সারা পৃথিবীর মানুষ ছি! ছি! রবে ধিক্কার জানিয়েছিল, হতবাক হয়েছিল মানুষের প্রতি মানুষের নির্মমতায়। ঘটনাটি হলো, অস্ট্রেলিয়ান একজন ধর্মযাজক, নাম গ্রাহাম ষ্টেইন্স, যিনি উড়িষ্যার মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ এবং বিশেষ করে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য কাজ করতেন । মানুষকে ভালোবেসে ছিলেন অতি আপন করে । সারাদিন মানুষের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এক রাতে দুই ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ চরমপন্থী হিন্দুরা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান । হায়রে মানুষ! নিঃসন্দেহে এটি একটি মর্মান্তিক দুঃখজনক ঘটনা, কিন্তু এর পরে যা ঘটল তা মহামানবীয় এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ ।
এই ঘটনার পর মৃত গ্রাহাম ষ্টেইন্স-এর স্ত্রী গ্রাডিস কোন বিচার বা প্রতিশোধ না নিয়ে শক্রদের ক্ষমা করে দিলেন। এটাই যথেষ্ট নয়, তিনি ও তীর মেয়ে ইস্টের সেখানে ৪০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল এবং কুষ্ঠ রোগীদের জন্য একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছেন। যেখানে ছুৎ-অচ্ছুৎ, আদিবাসী সর্বস্তরের মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়ে আমি মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি।” ক্ষমামরী গ্রাডিস এই মহৎ কাজটি করেছিলেন দয়ালু প্রভু যীশুর ক্ষমার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। প্রভু যীশড আশা করেন, আজ আমরাও যেন একে অপরকে ক্ষমা করে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই ও স্বীয় আনন্দ লাভ করি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় করা কি করা এত সহজ? অনাচার, দুরাচার আর সন্ত্রাসীতে যখন জনজীবন অতিষ্ট ও বিপন্ন, তখনও যদি এই ক্ষমা ধর্মকে বড় করে দেখা হয়, তখন সমাজের অবস্থা কি আরও মর্মান্তিক হয় না? না, আমি ক্ষমার বিপক্ষে নই, কিন্তু অনেকগুলি প্রশ্ন মনের মধ্যে ভিড় করে যেমন :
* যারা ক্ষমা করেন, তারা কি সত্যিই ক্ষমা করেন?
* যাদের ক্ষমা করা হয়, তারা কি সত্যিই ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত?
* যাদের ক্ষমা করা হচ্ছে, তারা কি ক্ষমার অর্থ বোঝে?
* ক্ষমা পাওয়ার পর কি তারা পরিবতীত হচ্ছে? ইত্যাদি।
সত্যি কথা বলতে কি, প্রকৃত ক্ষমা করতে গেলে বিনাশর্তে ক্ষতি, অপমান মেনে নিয়েই ক্ষমা করতে হয়। আবার ক্ষমা হয়ত করা যায়, কিন্তু ভুলা যায় না সহজে ।
যীশু ক্ষমার মহান আদর্শ । তিনি আমাদের ক্ষমার মূল্য হিসেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। প্রভু শীশুর ক্ষমা করার ধরনটি দেখলে উপরের উত্তরগুলি পাওয়া যায়। যেমন : সক্কেয় একজন করগ্রাহী, মহাপাপী। সাধারণত যারা ভাল মানুষ, তারা তার সাথে মিশতে চাইত না। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে, সে বীশুর কাছে আসবে, তাকে কাছ থেকে দেখবে । একদিন সেই সুযোগ আসল । অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রমের পর, সে একটি গাছের উপর থেকে বীশুকে দেখতে পেলো । যীশু ভালোবেসে সক্কেয়কে ডেকে হইবে" (লুক ১৯ : ৫)। যীশু তার ঘরে গেলেন, সঙ্গ দিলেন, এমন কি আহারও করলেন। জনসাধারণের কাছে পাপী হিসেবে পরিচিত এই পাপী মানুষটি যীশুর সান্নিধ্য ও ভালোবাসা পেয়ে সম্পূর্ণ নৃতন মানুষে পরিণত হলো। যীশু তার অনুতপ্ত হৃদয়, ভাল হওয়ার আকাঙ্খা ও সর্বোপরি তার অন্তর দেখে বললেন, “আজ এই গৃহে পরিত্রাণ উপস্থিত হইল ।” ক্ষমা পাওয়ার জন্য সক্কেয়কে কত মূল্য দিতে হয়েছে তার সঠিক হিসাব জানা নেই, তবে এটা জানা যায় যে, তার অসৎ আয়ের কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না বরং নিজের আসল বলে যা ছিল তা থেকেও অনেক দিতে হয়েছে।
অপব্যয়ী পুত্র যখন প্রকৃত অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ফিরে এসে ক্ষমা চাইল, তখন তার পিতা তাকে ক্ষমা তো করলেনই এবং আনন্দে হলেন আত্মহারা । এখানে ছেলেকে ক্ষমা করার জন্য পিতাকে যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়েছে অনেক, তেমনি ছেলেকে অনুতাপে দগ্ধ হতে হয়েছে এবং কৃত পাপের জন্য সে প্রায়শ্চিত্ত করেছে।
একজন মানুষকে কতবার ক্ষমা করা যায়, প্রশ্নের উত্তরে যীশু পিতরকে বলেছিলেন, শুধু সাত বার নয়, কিন্তু সত্তর গুন সাত বার পর্যন্ত ক্ষমা করতে হবে (মথি ১৮:২২)। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একটি জায়গায় বীশু নিজেই ক্ষমা করতে পারেননি । আর তা হলো মন্দিরে লোকেরা যখন ব্যবসা করছিল, তা দেখে যীশু শুধু রাগই করেননি, কিন্তু শক্ত হাতে চাবুক দিয়ে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন। এর কারণ কি? কারণ হলো, যিহুদীরা ভাল করেই জানত যে, মন্দির হলো ঈশ্বরের ভজনা করার পবিভ্রতম স্থান। আর তারা জেনে শুনে স্বত্ঞানে যখন অন্যায় করছিল, তখন যীশু তাদের ক্ষমা করতে পারলেন না। সুতরাং ক্ষমা করা ও ক্ষমা পাওয়া এত সহজ নয়, কারণ এর মধ্যে কিছু শর্ত থেকে যায়। যদিও ঈশ্বর ক্ষমার ঈশ্বর, দয়ার ঈশ্বর, প্রেমের ঈশ্বর ও শান্তির ঈশ্বর, তবুও তীর ক্ষমা ও দয়া পেতে হলে নিজেকে শূন্য করে তীর কাছে আসতে হয়, ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। জেনে শুনে ও স্বজ্ঞানে অন্যায় করলে ক্ষমা নাও পেতে পারি। প্রচুর প্রার্থনায় আমরা এই কথা স্বীকার করি যে, “আর আমাদের সকল অপরাধ ক্ষমা কর, আমরাও যেমন আমাদের অপরাধীদের ক্ষমা করি।” অর্থাৎ আমরা অন্যকে ক্ষমা করেত পারলে, আমরাও ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠি।
এটা ঠিক যে, যারা না জেনে বা না বুঝে অন্যায় করে, যীশু তাদের ক্ষমা করে দেন। যেমন তিনি ক্রুশের উপর থেকে বলেছিলেন, “পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কারণ ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না ।” যারা যীশুকে চরম অপমান করে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল, তাদেরকে ক্ষমা করা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? কিন্তু যীশু তা করেছিলেন, কারণ যীশু জানতেন যে, লোকগুলি তীর প্রতি যা করেছিল তা না বুঝে ও না জেনে করেছিল। তারা সত্যিই যদি যীশুকে চিনত, তাহলে কি যীশুর প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারত? পীলাত কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন যে যীশু সাধারণ কেউ নন এবং তিনি নির্দোষ তাই যীশুকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যীশুকে চিনতে না পারা জনগণের প্রতিবাদে বাধ্য হয়ে তিনি যীশুকে শাস্তি দিয়েছিলেন এবং হাত ধুয়ে নিজে নির্দোষ থাকতে চেয়েছিলেন । দু'একজন সৈন্য যারা যীশুকে খুব কাছ
থেকে দেখেছিল ও তীর কথা শুনেছিল, তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে যীশু নির্দোষ এবং অন্তরে উপলব্ধি করে বলেছিল, “না-না, এই মানুষটির প্রতি যা করেছি, তা মহাভুল করেছি, ভীষণ অন্যায় করেছি” । অরিমাথিয়া নগরের যোষেফ যীশুকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই নিজের অব্যবহৃত মূল্যবান কবরটি ব্যবহার করতে দেওয়াসহ যীশুর সমাধিস্থ করার সকল দায়িতৃ যত্রের সাথে পালন করেছিলেন। আবার ঈস্কোরিয়োতীয় যিহুদা যখন যীশুকে সত্যিকারভাবে চিনতে পেরেছিল, তখন অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে হয়ত বলেছিল, “হায়! হায়! আমি এ কি করেছি!” যে টাকার লোভে সে যীশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল, সেই টাকা ফেরৎ দিয়েও তার অন্তর্কালা কমেনি, অবশেষে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল।
যে সকল লোক যীশুকে চিনত বা জানত তারা যীশুকে মারতে চায় নি। জানি না, সেখানে এমন লোক কেউ ছিল কিনা, যারা জেনে শুনে যীশুকে হত্যা করেছে। তবে অধিকাংশ লোক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, যীশুই স্বয়ং ঈশ্বরের পুত্র। যদিও যীশু তাঁর জীবন ও কাজ দ্বারা বুঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা আরও যীশুকে দায়ী করেছে এই জন্য যে, তিনি নিজেকে নিজেই “ঈশ্বরের পুত্র” বলে দাবি করে ঈশ্বরের নিন্দা করেছেন। আর যার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। তাই চিৎকার করে বলেছিল “ক্রুশে দাও, ওকে ক্রুশে দাও” ।
অধিকাংশ লোক বীশুকে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে জানত। তাই যীশুর প্রার্থনা, “পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কারণ ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না।” যেহেতু তারা জানে না, তাই ক্ষমা পেল। কিন্তু এমন যদি হতো, তারা জেনে শুনে বীশুকে ক্রুশে দিল তাহলে বিষয়টি কেমন হতো? এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি আমাকে বারবার দ্বিধায় ফেলে তা হলো, সত্যি যদি তারা জেনে শুনে এমনটি করত তাহলে যীশুর প্রার্থনা কি এই রকম হওয়া উচিত নয়? “পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা করো না, কারণ ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে ।” সাধারণ যুক্তিতে হয়ত এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবে এটি আমার একান্তই অনুর্বর মস্তিস্কের উট চিন্তা মাত্র। আজ আমরা যাঁরা সবীষ্টিয়ান, যারা যীশুকে চিনেছি জেনেছি বলে দাবি করি এবং আমরা যখন জেনে শুনে খরীষ্টকে কষ্ট দিই বা তীর বিরুদ্ধে পাপ করি, তখন সেই পাপের ক্ষমা পাওয়া কি এতই সহজ?
এই প্রশ্ন আমার নিজের কাছে, এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে। প্রেমময় ঈশ্বর আমাদের সুমতি দান করুন যেন আমরা আর জেনে শুনে পাপ না করি। তবে আশার বিষয়, যারা প্রকৃত অনুতাপ সহকারে নিজের পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করে ও নম্তায় প্রভুর চরণে নিজেকে সমর্পণ করে ও ক্ষমা চায় প্রভু তাদের ক্ষমা করেন।