পবিত্র ত্রিত্ব ও বড়দিন

ads20
    খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসের মর্মমূলে আছে পবিত্র ত্রিত্ব বা   স্বর্গমর্ত, দৃশ্য-অদৃশ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ও ধারণকর্তা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর শাশ্বতকালব্যাপী তিন ব্যক্তিসত্তায় বিরাজমান এবং সৃষ্টির কাছে তিনি নিজেকে সেভাবে প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি একমাত্র ঈশ্বর। ত্রিত্ববাদ বড় এক রহস্য। তা এক আত্মিক সত্য, যা সাধারণ চিন্তা ও জ্ঞানে বোঝা কঠিন, যুক্তি বা দর্শনের চিন্তায় তা বোধগম্য নয়। অথচ তা-ই হলো খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসের কেন্দ্রে। পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা—এই ত্রিবিধ ব্যক্তিসত্তায় বিরাজমান ও কার্যশীল হয়েও একমাত্র ঈশ্বর তিনি। এ ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য তাঁকে ব্যাখ্যা করা নয়। কালের পূর্ণতায় পুরাকালের ভাববাদীদের ভাববাণী সিদ্ধ করার জন্য পুত্র ঈশ্বর ঈশ-মানবরূপে পৃথিবীতে আগমন করেন। মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য সত্য ও অনুগ্রহে পূর্ণ ঈশ্বর থেকে যথার্থ ঈশ্বর পবিত্র আত্মার প্রভাবে কুমারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, স্বর্গ থেকে মর্তে অবতরণ করেন। তিনি সৃষ্ট নন, কিন্তু ঈশ্বরসঞ্জাত ঈশ্বর পাপের অধীন মানব মুক্তির কারণে পূর্ণ ও নিষ্পাপ মানব। অনুপম ও অদ্বিতীয় পাপ স্বভাবমুক্ত ঈশ-মানব বলে তিনি পাপের অধীন সব মানুষের মুক্তিপণরূপে তাঁর জীবন দিতে এ ধরায় এলেন। পবিত্র ও ন্যায়বান  ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের মান তিনিই সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করেছেন। পিতা ঈশ্বর তাঁর আজ্ঞা ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলা মানুষকে তাঁর পুত্রের আত্মত্যাগের মূল্যে তাঁর সঙ্গে সম্মিলিত করেছেন। বড়দিন তাই প্রেমময় ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের মিলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তা আমাদের কাছে সব মানুষের সঙ্গে প্রেমে ও সম্প্রীতিতে থাকার আহ্বান জানায়। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সুখবর দরিদ্র রাখালদের কাছে স্বর্গদূতরা এই গানের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন—‘ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি’ (নতুন নিয়ম, লুক ২:১৪)।

    সেদিনের সেই স্বর্গীয় গানে ছিল মানুষের প্রতি স্রষ্টার পবিত্র প্রেম ও মহা অনুগ্রহের বাণী; তা ছিল আবার মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্মান ও সম্প্রীতির একটি তাগিদ ও চ্যালেঞ্জ। যিশুখ্রিস্টের সময়ে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল ২৫ কোটির মতো। রোমান সাম্রাজ্যের সব লোকের প্রায় অর্ধেকই ছিল দাসপ্রথার শিকার, যাদের অনেকেরই  মানবাধিকার বলে কিছু ছিল না। স্বর্গের দূতদের উল্লিখিত আনন্দগান শুনেই সেই রাখালরা ছুটে গিয়েছিল শিশু যিশুকে দেখার জন্য। কারণ তারা জানতে পেরেছিল যে যিশু হবেন জগতের সব মানুষের মুক্তিদাতা, যিনি মানুষকে পাপ ও তার সব কুফল থেকে মুক্ত করবেন। পাপের ফলে দুর্বল ও দরিদ্র মানুষ সব ধরনের লোভ, হিংসা ও প্রতিহিংসার শিকার। দুর্নীতি, শোষণ, বিদ্বেষ ও ঘৃণায় মানুষের ব্যক্তি, সামাজিক ও জাতিগত জীবন বন্দি ও নিষ্পেষিত। পৃথিবীতে শান্তি-সম্প্রীতির ভালো ভালো বুলি ও বক্তৃতার তো শেষ নেই; কিন্তু প্রকৃত শান্তি ও স্বার্থহীন প্রেমের কাজ তেমন দেখা যায় না।
    পৃথিবীতে আজ প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে ধর্মীয় সহিংসতার বলি হচ্ছে মানুষ, ধর্মের নামে হচ্ছে অধর্ম। মধ্যপ্রাচ্য আজ নতুন নতুন ধর্মীয়, জাতিগত হিংসার আগুনে জ্বলছে; মিয়ানমারের আরাকানে ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত শুদ্ধতার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে চলেছে মানবতা; লাখ লাখ নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষের জীবন সীমাহীন অত্যাচারের শিকার হয়ে মানবেতর অবস্থানে নিপতিত দীর্ঘদিন ধরে। তাদের হেন অবস্থার শেষ কবে হবে, কবে বাংলাদেশ থেকে তাদের স্বদেশে স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তন, তা কি আমরা কেউ জানি? বিশ্ববিবেক আজ যেন শুধুই বাকপটু ও নিষ্ক্রিয় উৎকণ্ঠা নিয়েই বসে আছে। মানবাধিকার নিয়ে যেসব দেশ অনেক কথাই বলে আসছে, সেসব দেশ মিয়ানমারে তাদের সম্পদের স্বার্থে লক্ষ্মীর পূজাকে বেশি মূল্য দেয়।
    ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে ও অন্য মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহবাসের পথে চলার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা। বড়দিন শান্তিরাজ যিশুখ্রিস্টের পবিত্র জন্মদিন। বড়দিন পবিত্র ত্রিত্বের পবিত্রতম বন্দনা, সব সৃষ্টির জন্য তাঁর মহা অনুগ্রহের শ্রেষ্ঠতম দান ও উপহার। পবিত্র ত্রিত্বের কারণেই বড়দিন। ঈশ্বর মানুষ হয়ে মানুষের কাছে এলেন, যেন মানুষ ঈশ্বরের কাছে যেতে পারে; যেন মানুষ ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলির দ্বারা, তাঁর প্রেম, পবিত্রতা, ন্যায্যতা, আত্মিকতা ইত্যাদির প্রভাবে নতুন হয়ে চলার আহ্বান ও প্রেরণা লাভে ধন্য হয়। ত্রাণকর্তা খ্রিস্টের জন্মোৎসবের এ পবিত্র মাহেন্দ্র দিনে পবিত্র ত্রিত্ব আমাদের সবাইকে সেই জীবনের দিকে চলার সদিচ্ছা ও শক্তি দান করুন!

    লেখক: রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী,
    খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্ব্বের শিক্ষক ও সমাজকর্মী

    পরিচিতদেরকে জানাতে শেয়ার করুন

    আপনার জন্য আরো কিছু পোস্ট

    RELATED ARTICLES

      ADS